আবু রায়হান
সাপের মাথায় কী আসলেই মণি থাকে?
সাপের মাথার মনি আজীবনই রহস্যময় একটা বিষয় ছিল। কত কত সিনেমায় দেখেছি মণি সংগ্রহ করতে গিয়ে কত কত সাঁপুড়ে প্রাণ হারায়, আর কত তার গুণাবলী।
চলুন, আজ জানা যাক সেই সাপের মণির আদ্যোপান্ত।
সাপের মণির আরো অনেক নাম আছে। যেমন - স্কয়ার্জ স্টেইন , পিয়ের নয়ার, পাইদারিটাস নেগ্রাস , নাগমণি।
যাইহোক,
সাপের মাথায় আমরা যে অলৌকিক মণির অস্ত্বিতের কথা মনে করে থাকি, তা পুরোটাই রূপকথা। তবে মণি জাতীয় কিছু না থাকলেও সাপের মাথার অভ্যন্তরে পাথর জাতীয় কিছু থাকে। আসলে পুরোটাই বৈজ্ঞানিক বিষয়।
মূলত সাপের মাথায় কোনো পাথর/মণি প্রাকৃতিকভাবে থাকে না বা তৈরি হয় না। সাপের বিষ একটি বিষ গ্রন্থিতে তৈরি হয় এবং গ্রন্থি থেকে বিষ দাঁতে প্রবাহিত হয়। কখনো কখনো বিষ দাঁতের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। তখন এই বিষ জমা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। এটাকেই বলা হয় “সাপের মাথার মণি”। এই ঘটনাটি প্রকৃতিতে খুবই দুর্লভ।
বিষধর সাপের মাথার অভ্যন্তরে এ বিষথলি থাকে। এসব বিষথলিতে বিষ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না হলে বা দেহ থেকে নিঃসৃত না হলে, তা সে বিষথলি/gland এই জমা হতে হতে শক্ত হয়ে যায়। আর সেটা শক্ত হয়ে কালো পাথরে আকার ধারণ করে। যেটাকে ইংরেজিতে 'ব্ল্যাক স্টোন' বলে থাকে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাপুড়িয়ারা আমাদের সাথে ভাঁওতাবাজি করে থাকে। সাধারণ সাপের বিষথলিতে বিষ জমবে কীভাবে - যেখানে এসব বিষই নেই।
সাপুড়িয়ারা এক্ষেত্রে ভীষণ ধূর্তামিপূর্ণ ট্রিকস অবলম্বন করেন।
আমরা জানি,
সাপ এক প্রকার সরীসৃপ। এর দেহে, মূলদেহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তুলনামূলকভাবে পুরু ও ফ্লেক্সিবল একটি খোলস থাকে। কাঁকড়া, তেলাপোকা ইত্যাদি আর্থোপোডা পর্বের প্রাণীদের যেমন থাকে। এই খোলস সাপের দেহকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের যখন সাপের দেহের বৃদ্ধি ঘটে, তখন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে। বৃদ্ধি শেষে তার দেহে এমন আরেকটি পুরু ও ফ্লেক্সিবল খোলস তৈরি হয়ে যায়। আমরা সাপের বাইরে এই খোলস টিকেই দেখি। যাদের গ্রামে ভ্রমণের অভ্যাস আছে তারা হয়ত এরকম সাপের খোলস পরে থাকতে দেখে থাকতে পারেন। এই খোলসটি ভেতরের সাপের দেহের সাথে চামড়ার মতো লাগানো থাকে না। অনেকটা চিংড়ি ও কাঁকড়ার খোলসের মতো ফাঁপা অবস্থায় এই খোলসের ভেতর সাপের মূল দেহ থাকে। আপনি চাইলে সাপের এই খোলসের এক প্রান্ত একটু কেঁটে টান দিলে ভেতরের পুরো সাপটিকে খোলস থেকে বের করে আনতে পারবেন। সাপের এই বৈশিষ্ট্যটিই ব্যবহার করে সাপের মাথার মণি দেখান হয়ে থাকে।
এই সর্প-মণি বিশারদরা প্রথমে একটি সাপের ব্যবস্থা করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিষহীন সাপ এই কাজে ব্যবহার করে। তারপর তারা সাপের লেজের দিকে অল্প একটু কেঁটে সেখানে একটি রঙ্গিন পাথর প্রবেশ করায়। তাহলে পাথরটি থাকে সাপের পাতলা চামড়ার বাইরে এবং শক্ত খোলসের নিচে। তারপর এটিকে রাবারের টিউবের মতো চেপে চেপে লেজের দিক থেকে পাথরটাকে সাপের মাথায় নিয়ে আসা হয়। এই সম্পূর্ণ কাজটি ঘটে আপনার অগোচরে। এরপর তারা পূর্বে প্রস্তুতকৃত সাপটিকে নিয়ে আসে আপনার সামনে।
আপনার লক্ষ্য থাকে সাপের মাথায়, লেজে নয়। তারপর আপনি যখন সাপটির মাথাটা কাটেন, তখন বেরিয়ে আসে সেই আগে থেকে প্রস্তুত পাথরটি। যেটিকে সাপের মাথার মণি বলে চালিয়ে দেয়া হয়, এবং হাতিয়ে নেয়া হয় মোটা অংকের টাকা।
এই গুপ্ত বৈজ্ঞানিক কৌশলটা যদি আপনার জানা না থাকে তাহলে আপনার বিশ্বাস করে নেয়াটা অস্বাভাবিক না যে সাপের মাথায় মণি থাকে, সেটা খুব দামী ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী।
তবে থাকুক আর না থাকুক, এটি কখনোই কোনো
ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী নয়।
এমনকি আপনার ভাগ্য নির্ধারনের কোন ক্ষমতাই এর নেই। আর এটি আংটিতে ব্যবহার করার মতো কোনো কঠিন পাথরের মতো ও হয় না। তরল বিষ কঠিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে একটা irregular অবয়ব তৈরী করে মাত্র। অথচ সর্প-মনি বিশারদরা আপনাকে সাপের মাথা থেকে এনে দেবে সুন্দর আকৃতির একটি রঙ্গিন পাথর।
আসলে পুরোটাই ওজাদের ধোঁকাবাজি।
তবে Snake Catcher -রা সাপ ধরার সময় ঐ শুষ্ক শক্ত বিষকে সাপের মাথা চাকু দিয়ে হালকা কেটে বের করে ফেলেন। এতে সাপের মৃত্যু হয়না।
[ভিডিও-https://youtu.be/JtHOyMtqsJU ]
তবে এটির সাপের বিষ ঝেরে ফেলার বা শোষণ করার কোনো প্রমাণ আদৌ বিজ্ঞান পায়নি। পুরোটাই একটা মিথ।
তাহলে এ মিথ কীভাবে তৈরি হলো?
প্রায় ৩০০০ প্রজাতির সাপের মাঝে মাত্র ৬০০ প্রজাতির সাপ হলো বিষধর। আর তার মাঝে ২০০ প্রজাতির সাপ (প্রায় ৬%) মানুষের শরীর ও অঙ্গের জন্য হুমকিস্বরূপ। ধরুন কখনও কোনো সাপ কামড়ালো। সাপটা কিন্তু বিষহীন বা হুমকি না হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০%। ধরুন, বিষহীন সাপই কামড়ালো। না ধরেন বিষাক্ত সাপই কামড়ালো তখন?
তবে জেনে নিন, ৫টা বিষাক্ত সাপের মাঝে ৪টাই বিষহীন কামড় দেয়।
বিষাক্ত সাপ বা যেকোনো সাপের কামড় হলো, প্রতিরক্ষামূলক। এক্ষেত্রে সাপ জাস্ট কামড় দেয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে। বিষ ছাড়ে না। আর যাদের ছাড়ে তারা হয়তো চিকিৎসা- নিয়ে ভালো হয় বা মারা যায়। সাপুড়ের চল তো ওঠেই যাচ্ছে। যারা সাপুড়ে দেখায় তাদের বেশিরভাগই বিষহীন সাপের কামড়ের প্রতিকার রূপে সাপুড়ে দেখায়।
সাপুড়ে এসে সে শক্ত বিষ জমা পাথরটা ভুজংভাজাং হিসেবে বিষহীন সাপের কামড়ে ব্যবহার করে। রোগী কিন্ত এমনিতেই সেরে যেত। মাঝখান থেকে নাম হলো পাথরের বা কথিত সাপের মনির ও সাপুড়ের।
এই হলো আসল কাহিনী। যেহেতু বেশিরভাগ সাপই বিষহীন, তাই বেশিরভাগ সাপে কাটা রোগীর শরীরে বিষ প্রবেশ হতে পারে না। আর তাদের সারিয়ে তোলাও সহজ সাপুড়েদের পক্ষে।
ফলে, সহজেই এ সাপের মনির বিষয়টা মিথ হিসেবে ছড়িয়ে গেছে। তার ওপর আমাদের প্রাচীন, বিজ্ঞানবিমুখ জাতির কুসংস্কার তো আছেই।
বর্তমানে কীভাবে মণি সংগ্রহ/তৈরি হয়?
উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী,
সাপের মনি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করে মনি পাথর তৈরি করতে গরুর হাড় /বিভিন্ন প্রাণীর হাড়কেও ব্যবহার করা হয়।
এক্ষেত্রে তারা যা করে,
১. প্রথমে কোনো মৃত গোরুর শুষ্ক উরুর হাড় বেছে নেয়,
২. তারপর সে হাড়কে ছোটো ছোটো খন্ড করা হয়,
৩. তারপর শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘর্ষণ করে মসৃণ করা হয়,
৪. তারপর Foil কাগজ দিয়ে তা মোঁড়ানো হয়,
৫, তারপর সে হাড়কে কয়লার আগুনে ১৫-২০মিনিট পোঁড়ানো হয় এবং পুঁড়ালে তা কালো হয়ে যায়। এভাবে কথিত মণি তৈরি করা হয়।
তবে আগেই বলেছি বিষাক্ত সাপের মাথা/লেজের বিষগ্রন্থি থেকেও কথিত মনি সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা সাপের জমে শক্ত হয়ে যাওয়া বিষ যাকে রংচং মাখিয়ে মণি হিসেবে উত্থাপিত হয়।
সোর্স - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Snake-stone
যাই হোক কৃত্রিম এ পাথর বা হাড়কে সাপের কামড়ের জায়গায় বসানো হয়।
তারপর সেটা একসময় বিষ শোষণ করে মাটিতে আপনা আপনিই পড়ে যায়।
কিভাবে সম্ভব?
ব্যাখ্যা করতেছি-
গোরুর এ হাড়গুলো সাধারণত অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হয়। মনে করে দেখেন-
গোরুর হাড় চিবুতে গিয়ে অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হাড়ের দেখা পান নি?
সবাই পেয়েছেন জানি।
সে হাড়গুলো তারা খুব শুষ্ক রাখে যাতে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় হাড়গুলো বিষের রস শোষণ করতে পারে তার অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে।
বলেন তো, টিস্যু পেপার বা কাগজ কেন এত পানি শোষণ করতে পারে?
টিস্যু পেপারের পানি শোষণ করার ঘটনাটার মতো হুবুহু ঘটনা সেখানেও ঘটে। কিন্তু তা আমাদের সামনে রং মাখিয়ে উপস্থাপন করা হয় যেন আমরা সে সস্তা পাথরকে মূল্যবান পাথর ভাবি এবং তাদের ভণ্ডামি ব্যবসার যেন প্রসার হয়।
তাহলে পাথরগুলো বিষ শোষণ করে আপনা আপনি পড়ে যায় কেন?
সেটার জবাবও আছে।
মূলত হাড় নামের কথিত পাথরগুলো ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বিষ শোষন করে ফুলে ফেঁপে উঠে। টিস্যু যেরকম পানি শোষণ করে ভারি হয়ে যায় ঠিক তেমন। রক্তের সাথে বিষ শোষণের ফলে একটা সময় পাথরগুলো ভারি হয়ে যায়। তখন আর ভারের কারণে সেখানে আটকে থাকতে পারে না। এমনেই মাটিতে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো।
খেয়াল করেন, পুরোটাই কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। এখানে কোনো অলৌকিকতা নেই। রক্ত বাহ্যিক শুষ্ক এবং ছিদ্রময় বস্তুর টানে বাইরে নির্গমন হওয়াকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় Capillary Action (কৈশিক জালিকার ক্রিয়া) বলে যা ইমবাইবিশনের মতোই (কলয়েড জাতীয় শুকনা বা আধাশুকনা পদার্থ কর্তৃক তরল পদার্থ শোষণের বিশেষ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইমবাইবিশন। )
তারপর সে পাথরটাকে মাটি থেকে তুলে দুধ দিয়ে ধৌঁত করা হয় - যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। অলৌকিক ভাব আনতেই অমন করা হয়।
সবচেয়ে ভয়ংকর খবর হলো, এ পাথরাকৃতি বস্তুটা উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো বিষই শোষণ করতে পারে না। তবে হালকা শোষণ করে ব্যাপন প্রক্রিয়ায়। তাছাড়া অনেক সাপুড়িয়া এ পাথরটাকে ১ম দুধে চুবিয়ে নেয়। তারপর তা থেকে পাথরটা সরিয়ে সে দুগ্ধ রোগীকে খেতে দেয়। তারপর ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে প্রবাদটার প্রয়োগ হয় এখানে। মারা গেলে বলা হয হায়াত ছিল না।
তবে তবুও এ পাথর প্রারম্ভিকভাবে ফার্স্ট এইড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এতে রোগীর মনে সাপের ভয়ে মারা যাওয়ার ভয়টা কেটে যাবে অনেকাংশে। প্লাসিবো ইফেক্টের মত আর কী।
তা না হলে ভয় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে গেলে রক্ত প্রবাহ অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে রোগীকে সমস্যায় ফেলে দিবে।
এই হলো সাপের মনির কেচ্ছা।
নেন আরো সাপের মনির পেছনে দৌঁড়ান, আর বনবাদারে সাপ বিচ্ছুর কামড় খেয়ে সাপ নামক নিরীহ প্রাণীর চৌদ্ধগুষ্ঠী উদ্ধার করেন।
সোর্স:
1/ https://www.standardmedia.co.ke/health/article/2000178716/mombasa-school-girls-develop-a-stone-that-sucks-poison-out-of-snake-bites
2/ https://www.quora.com/What-are-snake-stones-and-how-do-they-work
3/ https://steemit.com/health/@bliss01/how-to-use-black-stone-for-treatment-against-snake-scorpion-poison
4/ https://en.m.wikipedia.org/wiki/Snake-stone
5/ https://youtu.be/JtHOyMtqsJU
আবু রায়হান,
ব্যাঙের ছারাত বিজ্ঞান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন