আসিফ আফতাব সোহাগ
উত্তরঃ
না। তাহলে এই গুজব আসলো কোথা থেকে? এটা হয়তোবা না যাচাই করেই বিশ্বাস করে নেওয়া সেই লোকদের থেকে ছড়িয়েছে, যারা কোনো মৃত ব্যক্তির নখ আর চুল এর আকার খেয়াল করে রেখেছিল এবং কয়েকদিন পরে মৃত ব্যক্তিটির কাছে গিয়ে দেখে নখ আর চুল বড়ো দেখাচ্ছে।
মৃত্যুর পর নখ আর চুল কেনো বড়ো হয় না এটা জানতে হলে আগে জানতে হবে নখ আর চুল কী এবং জীবিত থাকা অবস্থায় কেনো এগুলো বাড়ে। [শুধু গুজবটা রটার কারণ জানতে চাইলে শেষ প্যারা দেখতে পারেন।]
আঙুলের গোঁড়ায়, নখ যেখানে ত্বকের সাথে মিশে গেছে, এই অংশটুকুকে বলা হয় কিউটিকল। এর ভেতরের দিকে, আঙুলের আরো গভীরে থাকে নখের মূল; একে ম্যাট্রিক্স বলা হয়। এই ম্যাট্রিক্স থেকেই অনবরত নখের সৃষ্টি হতে থাকে। নখগুলো গোড়ার দিকে যেখানে গিয়ে ত্বকে মিশেছে, সেখানে সম্পূর্ণ সাদা অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটি অংশ দেখা যায়। না দেখতে পেলেও সমস্যার কিছু নেই, সাধারণত দেখা যাবার কথা নয়। বৃদ্ধাঙ্গুলির দিকে তাকালে হয়তো স্পষ্ট দেখা যেতে পারে। এই অংশটুকুকে বলা হয় লুনুলা, এটি ত্বকের নিচে ম্যাট্রিক্সের বাড়তি অংশ। অর্ধচন্দ্রাকৃতির হওয়ায় এর নাম হয়েছে লুনুলা। নখ এবং চুল মৃত কোষ দিয়ে তৈরি। কোনো ধরনের স্নায়ু সংযোগ থাকে না বলে নখ কিংবা চুল কাঁটলে আমরা ব্যথা পাই না। কিন্তু নখের ম্যাট্রিক্স অংশটুকু মৃত নয়, জীবিত কোষ দ্বারা তৈরি হয়েছে। ত্বকের নিচে এর সাথে রক্তবাহিকা এবং স্নায়ু সংযুক্ত থাকে। রক্তবাহিকার মাধ্যমে পর্যাপ্ত পুষ্টি পেয়ে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নতুন নতুন কোষ তৈরি করে এই ম্যাট্রিক্স, নতুন তৈরি হওয়া কোষগুলোকে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়, যা কিউটিকল পার করে বাইরের দিকে উন্মুক্ত হয়। নখ হিসেবে আমরা যে অংশটুকুকে চিনি সেই শক্ত আবরণটুকুকে বলা হয় 'নেইল প্লেট'। ম্যাট্রিক্স কোষ থেকে অনবরত কেরাটিন কোষ তৈরি হয়ে বাইরে এসে নেইল প্লেট তৈরি করে। এই কোষগুলো কেরাটিন জাতীয় প্রোটিন তৈরি করে বলেই এরা মারা যাওয়ার পর শক্ত হয়ে যায়। নখের ঠিক নিচে একস্তর জীবিত কোষের আবরণ থাকে। এই জীবিত কোষের আবরণ নেইল বেড নামে পরিচিত। এতে রক্তবাহিকা এবং স্নায়ু রয়েছে। এজন্যই নেইল বেড কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা ব্যথা পাই। নখ এবং চুল হিসেবে আমরা যেটুকু দেখছি পুরোটাই মৃত কোষে তৈরি। কিন্তু আমরা নখ বা চুল কাঁটার সময় অগ্রভাগে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কাঁটতে পারি, ভেতরের দিকে কাটতে গেলেই ব্যথা লাগবে। মৃত কোষে নির্মিত নখ প্লেটে ব্যথা হয় না, যদি নখ উপড়ে ফেলা হয় কিংবা কাঁটা হয়, নেইল বেডে থাকা স্নায়ুর জন্যই আমরা ব্যথা পেয়ে থাকি। নেইল বেড যদি অক্ষত থাকে, নেইল প্লেট ঠিকমতো পুনরায় তৈরি হয়ে যাবে। নখের বেড়ে উঠা খুবই ধীরগতির। পায়ের নখগুলো হাত থেকে আরো ধীর গতিতে বেড়ে উঠে। হাতের নখ প্রতি মাসে ৩ মিলিমিটারের মতো বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অর্থাৎ ছয় মাসের ভেতর একটি আঙুলের সম্পূর্ণ নেইল প্লেটটি প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে নতুন নেইল প্লেট দ্বারা। কোনো দুর্ঘটনায় যদি নখের কোনো ক্ষতি হয়, চিন্তার কোনো কারণ নেই, নেইল বেড ঠিক থাকলে ৫-৬ মাসেই নতুন নখ তৈরি হয়ে যাবে। আর পায়ের নখগুলো প্রতিমাসে ১ মিলিমিটারের মতো বাড়ে, পুরো নেইল প্লেট প্রতিস্থাপিত হতে সময় প্রয়োজন প্রায় এক থেকে দেড় বছরের মতো।
চুলের বড়ো হওয়ার প্রক্রিয়াও প্রায় একই রকম তাই আলাদা করে বারতি কিছু বলার দরকার নেই। চুলের প্রধান উপাদানও কেরাটিন। মাথার স্ক্যাল্পে প্রায় এক লক্ষ এর মতো ফলিকল আছে। ফলিকলের নীচে প্রতিটি গোড়া থেকে চুল বাড়তে শুরু করে। মূলটি প্রোটিনের কোষ দ্বারা গঠিত। মাথার ত্বকের রক্তনালীগুলি থেকে রক্ত শিকড়কে পুষ্টি যোগায়, যা আরও বেশি কোষ তৈরি করে এবং চুল বাড়ায়। একটি চুল বছরে প্রায় ছয় ইঞ্চির মতো বড়ো হয়। চুল স্ক্যাল্পের ভেতর ধাক্কা খেয়ে বড়ো হওয়ার সময় তেল গ্রন্থি চুলে তেল যোগ করে চুলকে চকচকে এবং নরম রাখে। এটি চুলকে চটচটেও করতে পারে। এজন্য আমাদের চুল ধোয়ার প্রয়োজন পড়ে। শরীরের অন্যান্য অংশের চুল গুলোউ প্রায় একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড়ো হয় কিন্তু পুরো চক্রটি চলে ধীরগতিতে। তাই শরীরের অন্যান্য অঙ্গের চুলগুলো মাথার চুলগুলোর মতো তাড়াতাড়ি বড়ো হয় না।
বারংবার কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নখ এবং চুলের বেড়ে ওঠা খুবই প্রয়োজনীয়। নখ এবং চুল গুলো যদি দাঁতের মতো স্থায়ী হতো তাহলে হয়তোবা আমাদের কষ্ট করে নখ বা চুল কাটা লাগতো না। আর নখ এবং চুল কাটা নিয়ে এত ভাবতেও হতো না। কোনো দুর্ঘটনায় নখ পড়ে গেলে বা অতিরিক্ত গরমের কারণে চুল কেটে ফেললে সেখানে পুনরায় গজানোর সুযোগ থাকে। দাঁতের মতো স্থায়ী কিছু হলে এই সুযোগ আর থাকতো না। একবার নষ্ট হলে কিংবা উপড়ে গেলে বাকি জীবন নখ বা চুল ছাড়াই থাকতে হতো। মানব শরীরে নখ আর চুলের গুরুত্ব কম নয়।
বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া নখ এবং চুলের এই বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া চলতে থাকে সারা জীবন ধরে। হাতের নখ বা চুল বড়ো হতে হলে নতুন কোষ গঠনটা আবশ্যক। কিন্তু মৃত্যুর পর এই জটিল প্রক্রিয়াটা কোনোমতেই ঘটতে পারে না। কারণ কোষ বিভাজনের জন্য প্রয়োজন হয় গ্লুকোজ। যেটা তৈরি হয় অক্সিজেনের সাহায্যে। হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শরীরের আর কোনো অংশে অক্সিজেন পৌঁছায় না। ফলে কোষগুলোও হয়ে পড়ে নিস্তেজ। ব্রেইন সেলস গুলোউ কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায়। অন্যান্য অঙ্গও (যেমন: কিডনি, লিভার) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্য জীবিত ব্যক্তির শরীরে স্থাপন না করলে ড্যামেজ হয়ে যায়। নখ আর চুল বড়ো হওয়ার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিটির পর্যবেক্ষকদের নিকট তৈরি হয় একটা বিভ্রম। নখগুলো আর বৃদ্ধি না পেলেও এর চারপাশের চামড়াগুলো আদ্রতা হারানোর কারণে সংকুচিত হয়ে আসে। তখন মনে হয় যেন নখগুলোই আকারে বাড়ছে। চুলের ক্ষেত্রেও ঘটে কমবেশি একই ঘটনা। মৃত্যুর পর যখন চিবুকের চামড়াগুলো সংকুচিত হয়ে আসে তখন মনে হয় যেন দাড়ি-গোঁফগুলো আকারে বাড়ছে। আর মাথার খুলির ওপরে থাকা চামড়া সংকোচনের কারণে মনে হয় চুল বড়ো হচ্ছে।
সোর্স:
https://www.livescience.com/32174-do-hair-and-nails-keep-growing-after-death.html
https://www.bbc.com/future/article/20130526-do-your-nails-grow-after-death
https://roar.media/bangla/main/science/how-our-fingernails-grow
https://www.aad.org/public/parents-kids/healthy-habits/parents/kids/hair-grows#:~:text=Your%20hair%20begins%20growing%20from,oil%20gland%20along%20the%20way.
আসিফ আফতাব সোহাগ
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন