আবু রায়হান
আমাদের কি কেবল পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে
না কি আরো বেশি ইন্দ্রিয় আছে ?
ইন্টারের জীববিজ্ঞান বই (গাজী আজমল ও গাজী আসমত স্যার) মানব শারীরতত্ত্ব : সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ অধ্যায়সহ অন্যান্য বিভিন্ন বইয়ে আমরা প্রায় সর্বত্র শুনে ও জেনে এসেছি যে বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি প্রাপ্তির জন্য আমাদের মোট পাঁচটি ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক) রয়েছে।
কিন্তু বিষয়টা অতটা সরল না।
আমাদের দেহ কেবল পঞ্চ ইন্দ্রিয়তেই সীমাবদ্ধ নয়; আরও অনেক অনেক ইন্দ্রিয়ের সাহায্য আমরা নিয়ে থাকি। তাই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধারণা এখন একটি বাজেয়াপ্ত ধারণা।
তথাকথিত ওসব পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে সেসব অতিরিক্ত সেন্স রয়েছে, সেসব ছাড়া কেবল পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আপনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন না। স্বাভাবিক জীবন ধারণে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সেন্সগুলোরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মূল কথায় আসি--
“মানুষের শুধুমাত্র পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে”–কথাটি ভুল!
মানুষের পাঁচটির চেয়ে আরও অনেক বেশী ইন্দ্রিয় রয়েছে এবং অধিকাংশ গবেষক মনে করেন সংখ্যাটি বিশ বা তারও বেশী!
কারো মতে ৯/২১/২২/৩৩/৪০/৫৩টি।
যা-হোক, ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে মতভেদ থাকতেই পারে কিন্তু নির্দিষ্ট করে পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে এ কথা বলাটা মোটেই ঠিক নয়।
ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা, হোক তা ৯/২১/২২/৩৩/৪০ বা ৫৩, তা বিবেচ্য বিষয় নয়; মূল কথা হলো ইন্দ্রিয় সংখ্যা যে পাঁচটির মাঝে সীমাবদ্ধ নয় সেটা স্পষ্টভাবেই বলা যায়।
সাধারণত যে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কথা আমরা জেনে এসেছি, সেগুলো হলো–
১। দর্শণেন্দ্রিয় (Opthalmoreceptor)
২। শ্রবণেন্দ্রিয় (Audioreceptor)
৩। স্বাদেন্দ্রিয় (Gustaoreceptor)
৪। ঘ্রাণেন্দ্রিয় (Olfacoreceptor)
৫। স্পর্শেন্দ্রিয় (Tactioreceptor)
যা-হোক, নিউরোলজিস্টরা একেকজন একেক সংখ্যক ইন্দ্রিয়ের ব্যাপারে সংখ্যা তুলেন তবে কেউ-ই এখন আর ৫টি সেন্সের ধারণায় বসে নেই ।
যেমন কিছু ইন্দ্রিয় হচ্ছে-
১। Sight or vision (দর্শন ইন্দ্রিয়)
২। Hearing or audition(শ্রবণ ইন্দ্রিয়)
৩। Smell or olfaction(ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়)
৪। Taste or gustation(স্বাদ ইন্দ্রিয়)
৫। Touch or tactition(স্পর্শ ইন্দ্রিয়)
এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় নামে পরিচিত +বাকিগুলো হলো->
৬। তাপেন্দ্রিয় (Thermoception)
৭। ব্যথাইন্দ্রিয় (Nociception)
৮। ভারসাম্যেন্দ্রিয় (Equilibrioception)
৯।আত্মেন্দ্রিয় (Proprioception)
১০। খিদেন্দ্রিয় (Esurioreceptor)
১১। চাপেন্দ্রিয় (Baroreceptor)
১২। চুলকানেন্দ্রিয় (Purinergic receptor/purinoceptor)
১৩। তৃষ্ণেন্দ্রিয় (Osmoreceptor)
১৪। বর্জ্য-নিষ্কাশনেন্দ্রিয় (excretioreceptor)
১৫। রসায়নেন্দ্রিয় (Chemoreceptor)
১৬। সময়েন্দ্রিয় (Chronoreceptor)
১৭। চৌম্বকেন্দ্রিয় (Magnetoreceptor)
ইত্যাদি।
যেমন :
৬। তাপেন্দ্রিয় (Thermoceptor):
তাপমাত্রা পরিবর্তনের সংকেত প্রেরণে সক্ষম।
নিজের দেহের তাপ পর্যবেক্ষণ (monitoring) করা তাপেন্দ্রিয়ের প্রধান কাজ।
৭। ব্যথাইন্দ্রিয় (Nociceptor):
ব্যথান্দ্রিয়ের নিজস্ব স্বতন্ত্র সেন্সরি সিস্টেম খুঁজে পাওয়া যায়।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ব্যথান্দ্রিয়ের গ্রাহকগুলো মূলত কিছু সেন্সরি নিউরন যেগুলো বিভিন্ন ধরণের বাহ্যিক/অাভ্যন্তরীণ ক্ষতিকর (noxious) উদ্দীপনা গ্রহণে সক্ষম এবং এরা শরীরের প্রায় সব অঞ্চলেই অবস্থান করে।
৮। ভারসাম্যেন্দ্রিয় (Equilibrioceptor):
এই ইন্দ্রিয়টি আমাদের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা মাধ্যাকর্ষণের (gravity) অনুভূতি লাভ করি। এই ইন্দ্রিয়ের পরিচালক সেন্সরি সিস্টেমের নাম fluid filled vestibular system যা আমাদের অন্তঃকর্ণে অবস্থিত। ভারসাম্য রক্ষায় এবং চলমান অবস্থায় কোনো বস্তুর প্রতি দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত (focused) রাখতে এই ইন্দ্রিয়টি দর্শনেন্দ্রিয় ও আত্মেন্দ্রিয়ের সাথে একত্র হয়ে কাজ করে।
৯।আত্মেন্দ্রিয় (Proprioceptor):
এই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা শরীরের বিভিন্ন অংশের আপেক্ষিক অবস্থান বুঝতে পারি। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় যে, এই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আপনি চোখ বন্ধ করেই আঙ্গুল দিয়ে আপনার নাক/কনুই ঠিকভাবে স্পর্শ করতে পারেন, কিংবা আপনার পিঠের ঠিক জায়গাতেই চুলকাতে পারেন।
আপনার চোখ বন্ধ করুন। তারপর চোখ বন্ধ করেই কিন্তু নাক/শরীরের যে কোনো অঙ্গ টাচ করতে পারতেছেন।
এটাই আপনার Proprioception(প্রোপ্রিয়োসেপশন)
১০।খিদেন্দ্রিয় (Esurioceptor):
খিদের (hunger) বিপরীত শব্দ পরিতৃপ্তি (satiety)। খিদে লাগলে যেমন খাওয়ার ইচ্ছা জাগে তেমনি পরিতৃপ্তির ফলে খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়। এই খিদে ও পরিতৃপ্তি নিয়ন্ত্রণে দুইটি গ্রন্থিরস অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাদের নাম যথাক্রমে ঘ্রেলিন (ghrelin) ও লেপটিন (leptin)।
১১।চাপেন্দ্রিয় (Baroceptor) :
তাছাড়া আছে চাপেন্দ্রিয় (Baroceptor) যা মেরুদণ্ডী প্রাণীর ধমনীতে অবস্থান করে।
চাপেন্দ্রিয় সাধারণত রক্তচাপের প্রতি সংবেদনশীল।
এগুলো মূলত রক্তচাপের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধমনীগাত্রের সংকোচন/প্রসারণের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে।
আরও অনেক প্রকার ইন্দ্রিয়ের আলোচনা বিস্তারিত মেকানিজমসহ চাইলেই আলোচনা করা যাবে কিন্তু পোস্ট বড়ো হয়ে যাচ্ছে বিধায় আর বাড়ালাম না।
আবার, Eco-psychologist Michael J Cohen
এর সেন্সের সংজ্ঞায় ৫৩টির মত ইন্দ্রিয় পাওয়া যায়। (তবে ৫৩টি সেন্স সর্বস্বীকৃত নয়)
তিনি তার সেন্সের ডেফিনেশনে শারীরবৃত্তীয় ইন্দ্রিয়গুলোকে অতিক্রম করেন।
তিনি সকল প্রকার ইন্দ্রিয়কে চারটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করেন যার মাঝে ৫৩ প্রকার ইন্দ্রিয় পাওয়া যায়।
সেন্সগুলোর চারটি ক্যাটাগরি:
১। The radiation senses
২। The chemical senses
৩। The feeling senses
৪। The mental senses
নিচে ৫৩টি ইন্দ্রিয় লিস্ট করা হলো-
এর মাঝে প্রায় ২১/২২টি প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত ইন্দ্রিয়। বাকি ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে।
৫৩টি ইন্দ্রিয় ৫৩ রকমের কাজ করে।
নিচে তা উল্লেখ করা হলো-
__LIST of 53 SENSES__
1
Radiation_Sensitivities :


(চোখ ছাড়া দেখার অনুভূতি)







এবং পোলারিটি সম্পর্কিত সেন্স)
2
Feeling Senses :



(গ্র্যাভিটির প্রতি সংবেদনশীলতা)




(শূন্যতা বা সান্নিধ্যতার সেন্স)

(করিওলাস সেন্স < পৃথিবীর ঘূর্ণন >)

-(সংক্ষেপে-গতি বোঝার সেন্স)
3
Chemical Senses :
19. Smell with and beyond the nose
(নাক এবং নাক ছাড়াই ঘ্রাণ অনুধাবণের সেন্স)

(নাক এবং নাক ছাড়াই স্বাদ অনুধাবণের সেন্স)

(খাদ্য, পানি ও বাতাসের প্রতি ক্ষুধা/আকাঙ্ক্ষার প্রতি সেন্স)

(শিকার, হত্যা থেকে লব্ধ খাবারের প্রতি সেন্স)


4
Mental Senses :

(ব্যথার সেন্স-বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ)

(মানসিক অথবা আত্মিক বিপর্যয়ের প্রতি সেন্স)



(খেলা, রসবোধ, আনন্দ, হাসির প্রতি সেন্স)

(কোনো ভৌত জায়গা, ন্যাভিগেশন, মহাজাগতিক বস্তুর পজিশনের প্রতি সেন্স)

(সময়ের প্রতি সেন্স)

(ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রতি সেন্স)

(আবহাওয়া পরিবর্তনের সেন্স)

(ইমোশনের সাথে জড়িত জায়গা/বিষয়ের প্রতি সেন্স)

(নিজ বিষয়ক সেন্স-বন্ধুত্ব, সাহচর্য এবং ক্ষমতার প্রতি সেন্স)


(ঔপনিবেশনের সেন্স)



(নম্রতা,মূল্যায়ন,নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত সেন্স)

(গড়ন, রূপ, ডিজাইনের প্রতি সেন্স)

(স্মৃতি, যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌছানো, বিজ্ঞানের প্রতি সেন্স)



(নান্দনিক, শিল্পসম্পন্ন বস্তুর প্রতি সেন্স)


(জৈবিক, নাক্ষত্রিক সময়ের প্রতি সেন্স; অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত ঘটনার প্রতি সেন্স)

(অন্য কোনো সৃষ্টিকে সম্মোহন করার সেন্স)

(বিনোদন, ঘুমের প্রতি সেন্স-স্বপ্ন, ধ্যান, ব্রেইন ওয়েভ অ্যাওয়ারনেস)

(রেশম পোকা যেমন নিজের দেহ রূপান্তর করে তেমন মানুষেরও নিজের অবস্থা পরিবর্তনের চাহিদার প্রতি সেন্স)

(অত্যধিক স্ট্রেস, আত্মসমর্পনের প্রতি সেন্স)

(অধিক মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত/সংস্থাপিত কারোর সাথে সংযুক্ত হয়ে বাঁচার অনুভূতি)

--
From the work of Guy Murchie, The Seven Mysteries of Life
and Dr. Michael J. Cohen, Reconnecting to Nature--
সারকথা হলো ইন্দ্রিয় ৭/৯/১৪/২১/২২/৩৩/৪০/৫৩ যে কয়টাই হোক না কেন, ইন্দ্রিয় বলতেই যে আমরা ৫টি ইন্দ্রিয় বুঝে থাকি তা কখনোই সঠিক তথ্য নয়।
Sources :
[1] বিবিসি :
[2] ব্রিটানিকা :
[3] নিউইয়র্ক টাইমস :
[4] ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম :
[5]আইরিস টাইমস :
[6] ডিসকভার ম্যাগাজিন :
[7] উইকিপিডিয়া :
[8] লাইভসাইন্স :
[9] ন্যাকেড সাইন্টিস্ট :
[10] ফরসট্রি :
[11]স্টিমিট :
[12] সাইন্স.হাউস্টাফওয়ার্কস :
[13] হাউইটওয়ার্কস :
[14] বিগথিঙ্ক :
আবু রায়হান,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন