তাজউদ্দিন আহম্মদ
ইউটিউব।
পড়াশোনা, বিনোদন, জ্ঞান অর্জনের একটি সুন্দর মাধ্যম। তবে এর সাথে সাথে নানা ভুয়া তথ্য ও গুজবকে মানুষের কাছে মুখরোচকভাবে উপস্থাপন করে মানুষের মাথা খারাপ কয়ার মাধ্যমও বটে।
বিশেষ করে আমাদের দেশের বেশিরভাগ ইউটিউবার যেন এই কাজেই নিয়োজিত রয়েছে।
"যে রহস্যের সমাধান বিজ্ঞান দিতে পারেনি"
"প্রকৃতির আমীমাংসিত রহস্য"
"যে রহস্য আজও রহস্যই রয়ে গেছে"
এই টাইপের মুখরোচক টাইটেল ও থাম্বনেইল দিয়ে কোনো তথ্যকে অর্ধেকভাবে এমন করে উপস্থাপন করে,মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করে ভেবে নেয়,আসলেই এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
বিসিবিতে আজ এমন একটি ভিডিও এসেছে।ভিডিওর ক্রিয়েটর খুব সুন্দরভাবে অতি মুখরোচক ভাষায় ৫ টি জায়গার কথা উপস্থাপন করেছেন।
যেগুলোর নাকি কোনোই ব্যাখ্যা নেই।
তাই নাকি?চলেন দেখা যাক।
ভিডিওটির লিংকঃ
🚫জায়গা নাম্বার একঃ
জ্বিনের পাহাড় একেএ ওয়াদি আল জ্বিন।
এটা নিয়ে বিসিবিতে আমির প্যারাডক্সিক্যাল ভাইয়ের সুন্দর একটা পোস্ট আছে।
লিংক-
https://m.facebook.com/groups/bcb.science/permalink/3186136428136671/
সৌদি আরবের মদিনা থেকে ৩০ কিমি দুরে অবস্থিত ওয়াদি আল জ্বিন।
এটি একটি পাহাড়।কোনো সাধারণ পাহাড় নয়,এতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।এই পাহাড়ে গাড়ি উপরের দিকে উঠে।ইঞ্জিন স্টার্ট বন্ধ করে রাখলেও গাড়ি উপরের দিকেই উঠে। এমনকি গাড়িকে নিচের দিকে নিতে গেলে প্রচুর ফোর্স দিতে হয়।
অবাক কান্ড না!
না,মোটেও অবাক কান্ড না।অনেকে এর পেছনে চুম্বকের কথা বলেন(ইউটিউবাররাই বলে)।কিন্তু আসলে এর পেছনে চুম্বক নেই।
এই জায়গায় অভিকর্ষই কাজ করে।গাড়ি নরমালি অভিকর্ষই ফলো করে।অবাক হচ্ছেন?অভিকর্ষের প্রভাবে গাড়ি উপরে কিভাবে উঠে?
এখানে আসলে অপটিক্যাল ইলিউশন কাজ করে।গাড়ি নিচের দিকেই নামে,কিন্তু দৃষ্টিভ্রমের কারণে আমরা সেটাকে উপরের দিকেই উঠতে দেখি।এই ঢালু রাস্তাটির দিগন্ত আমরা দেখতে পাই না।
আর দিগন্ত দেখতে না পেলে আসলে বোঝা যায় না রাস্তাটি কোনদিকে ঢালু।
ফলাফল,রাস্তাটিকে আমরা উপরের দিকে উঠতে দেখি।আসলে সেটা নিচের দিকেই ঢালু।এ ধরনের পাহাড়কে বলা হয় গ্র্যাভিটি হিল।
সার্ভে করে এ ব্যাপারটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এই ধরনের পাহাড় কিন্তু শুধুমাত্র সৌদি আরবে নেই।আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া,টেক্সাস সহ বহু জায়গাতে দেখা যায়। এছাড়া মেক্সিকো,অস্ট্রেলিয়া,ব্রাজিল কানাডা,আর্জেন্টিনা,সাইপ্রাস,কোস্টারিকা,চীন সহ আরো অনেক দেশে এই গ্র্যাভিটি হিল আছে।
লিংক-
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gravity_hill
https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_gravity_hills
দেশের ইউটিউব চ্যানেলগুলো এমন ভাবে এটাকে ছড়িয়েছে,যেন এটা জ্বিনেরই কাজ।অথচ এর পেছনে রয়েছে বিজ্ঞান,ফিজিক্স।
🚫জায়গা নাম্বার দুইঃ
এই সৈকতটি যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত একটি সৈকত।
এই সৈকতে গ্রানিয়ান নামে একটি মাছের আধিক্য রয়েছে।গাল্ফ অব ক্যালিফোর্নিয়া কোস্টে এদেরকে প্রচুর দেখা যায়।
এই মাছগুলো তাদের একটি বৈশিষ্ট্যের কারণে বহুল পরিচিত।যখন এই মাছের ডিম পাড়ার মৌসুম আসে,এরা সমুদ্রের স্রোতের সাথে সৈকতে উঠে আসে।এই ঘটনাকে বিচিং বলা হয়।
এরা সৈকতের বালির মধ্যে নিজেদের লেজ দিয়ে গর্ত খুঁড়ে সেখানে ডিম পাড়ে।স্ত্রী মাছটি যখন ডিম পাড়ে,যখন পুরুষ মাছটি সেই ডিমকে নিষিক্ত করার জন্য তাকে বেস্টিত করে রাখে।
ইউটিউবার এই ঘটনাকে নিয়ে একটি ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন।ডিম পাড়ার পর নাকি এই মাছগুলো মারা যায়।
এটা সম্পূর্ণ ঘৃণিত মিথ্যাচার।
স্ত্রী মাছগুলো ডিম পাড়ে,পুরুষ মাছগুলো তাদের গায়ে স্পার্ম ত্যাগ করে দ্রুত সমুদ্রে ফিরে যায়।স্ত্রী মাছগুলো বালিতে আটকে থাকে ততক্ষণ,যতক্ষণ সেই স্পার্ম তাদের গা বেরে নিচে পড়ে এবং ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে।এবং স্পার্মগুলো ডিমে পৌছানোর পরেই তারা ফ্রি হয়ে সমুদ্রে ফিরে যায়।
মাঝে মাঝে এই প্রকিয়াটি মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে সম্পন্ন হয়।মাঝে মাঝে কিছু মিনিট লাগতে পারে।মাছগুলো মূলত সমুদ্রের পরবর্তী ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করে।এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংঘটিত হয় এক সিজনে এরা প্রায় ১৮,০০০ ডিম পাড়ে।
লিংক-
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Grunion
এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ইউটিউবার সাহেব কেন অমীমাংসিত বলে উল্লেখ করেছেন আমার জানা নেই।যেখানে এর পুরো ব্যাখ্যা অনেক জায়গায় দেয়াই আছে।
নেচারে এমন অনেক প্রাণী দেখা যায় যারা ডিম পাড়ার জন্য এমন উপায় অবলম্বন করে।
উপরন্তু তিনি মাছগুলোর মৃত্যু হবে উল্লেখ করে ডাহা মিথ্যাচার করেছেন।
🚫জায়গা নাম্বার তিনঃ
মাড ভলকানোঃ
সাধারণতভাবে আমরা ভলকানো বা আগ্নেয়গিরি বলতে বুঝি জ্বালামুখ দিয়ে লাভা উদগীরণ করা কিছু পর্বত।
তবে মাড ভলকানোগুলো এর ব্যতিক্রম।
মাড ভলকানোগুলো মূলত কাদাসমৃদ্ধ কোনো জায়গার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
এই ভলকানোগুলোতে লাভার বদলে মাটি থেকে কাদা বের হয়ে আসে।
কেন হয় এই ফিনোমিনন?
মাড ভলকানোর কাদামাটিগুলো আসে মাটির গভীরে পানিসমৃদ্ধ মাটি থেকে।
মাটির গভীরে অত্যধিক তাপমাত্রায় পানিযুক্ত মাটিগুলো উত্তপ্ত হয় এবং আগ্নেয়গিরির মতই প্রচন্ড প্রেশারে উপরের দিকে উঠে আসে।এই ফিনোমিনন ঘটে এমব জিওলজিক্যাল এরিয়ায়,যেখানে লোলাল সাবটেরেনিয়ান প্রেশার ইমব্যালেন্স থাকে।এই চাপের ফলে কাদামাটির আকারে এগুলো উপরের দিকে উঠে আসে।এর সাথে বিভিন্ন খনিজ পদার্থও মিশ্রিত থাকে।
এছাড়া মাটির গভীরে কোথাও উচ্চচাপের গ্যাসের স্তর থাকলেও এমন হতে পারে।
গ্যাস মাটির কাদার স্তরকে ঠেলে উপরের দিকে আসতে পারে।
ভূমিকম্পের কারণেও এমন ভলকানো তৈরি হতে পারে।
বেশিরভাগ মাড ভলকানো কোনো গিরিখাতের কাছাকাছি অবস্থিত হয়।
যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া,ভেনিজুয়েলা,ফিলিপাইনস,পাকিস্তান এবং কলম্বিয়ায় এ ধরণের ভলকানো রয়েছে।।
লিংক-
http://worldlandforms.com/landforms/mud-volcano/
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mud_volcano
এই ভলকানোগুলোর সুষ্পস্ট জিওলজিক্যাল ব্যাখ্যা রয়েছে এবং এটা কোনোভাবেই অমীমাংসিত রহস্য নয়,বরং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা।
🚫জায়গা নাম্বার চারঃ
বয়েলিং রিভারঃ
আরো একটি ন্যাচারাল ফিনোমিনন এবং আরো একটি মুখরোচক বিষয়।
রয়েলিং রিভার হলো এমন নদী,যার পানি অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ হয়।
শানাই-টিমপিস্কা বা লা বোম্বা নামে এমন একটি নদী রয়েছে,যা আমাজন নদীর একটি উপনদী।এই নদীর বৈশিষ্ট্য হলো,এর পানির অস্বাভাবিকভাবে গরম।
এই নদীর আশেপাশে এমন কোনো আগ্নেয়গিরি নেই যা তাকে তাপ সরবরাহ করতে পারে।
তাহলে কোথা থেকে আসে এই তাপ?
এর পেছনে রয়েছে পৃথিবীর জিওথার্মাল গ্রেডিয়েন্ট।এই নদীর পানির উৎস হলো বৃষ্টির পানি।যা আমাজন রেইনফরেস্টে পতিত হয়।এই বৃষ্টির পানি গভীর খাতের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর ক্রাস্টের কাছে যায়।এবং সেখানে অত্যন্ত বেশি তাপমাত্রার ফলে পানিও উত্তপ্ত হয়।
ফলে একটি হাইড্রোথার্মাল সিস্টেম তৈরি হয়।হাইড্রোথার্মাল সিস্টেম হলো সেসব জিওলজিক্যাল এরিয়া,যেখানে প্রচুর পরিনাণে পানি উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে।
উত্তপ্ত পানিগুলো বিভিন্ন ফল্ট এবং খাতের মাধ্যমে হাইড্রোথার্মাল সিস্টেম থেকে নদীর তলদেশে গিয়ে পৌছায়।
অর্থাৎ নদীর তলদেশের সাথে এই হাইড্রোথার্মাল সিস্টেমের সংযোগ রয়েছে।
তলদেশের উত্তপ্ত পানি হতে পরিচলন প্রক্রিয়ায় ভূমির পানির তাপমাত্রা উপর পর্যন্ত সঞ্চালিত হয়। ফলে নদীটি ভীষণ উত্তপ্ত হয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Shanay-Timpishka
🚫জায়গা নাম্বার পাঁচঃ
রিংগিং রকস পার্ক, পেনসিলভেনিয়াঃ
আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যে একটি পার্ক রয়েছে।সেখানে রয়েছে প্রচুর পাথর।সেই পাথরগুলোকে জোরে আঘাত করলে শব্দ হয়।মজার ব্যাপার না?
কেন হয় এই শব্দ?কোথা থেকেই বা এল পাথরগুলো?
এ জায়গায় প্রচুর পরিমাণে মেটালিক মিনারেলস এর আধিক্য রয়েছে।
যা থেকে এই পাথরগুলো কমপ্যাক্টিং প্রক্রিয়ায় মিনারেস জড়ো হয়ে তৈরি হয়েছে।
এখানকার কিছু পাথর আয়রন এবং অন্যান্য হার্ড মেটাল দিয়ে তৈরি।
সবগুলো পাথরেই কিন্তু সাউন্ড হয় না।
সেখানে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল এবং গ্রানাইটের পাথরও রয়েছে।
মূলত তিনভাগের এক ভাগ পাথর আয়রন বা অন্যান্য হার্ড মেটাল দিয়ে তৈরি।মেটালকে জোরে আঘাত করলে যেহেতু খুব জোর ভাইব্রেট করে,তাই মেটালে সাউন্ড তৈরি হয়।যা আমরা সবাই জানি।এই পাথরগুলোর ক্ষেত্রেও একই ম্যাকাকানিজম কাজ করে।এগুলোকে আঘাত করলে এরা ভাইব্রেট করে এবং সাউন্ড তৈরি করে।
এই পাথরগুলো বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।মানুষ শৌখিনতার বশে এবং রিংগিং রকস সংগ্রহ করে।
এখানকার যেসব পাথর শব্দ তৈরি করে সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে লিভিং রকস অর্থাৎ জীবন্ত পাথর, আর যেসব পাথর শব্দ তৈরি করে না,সেগুলোর নাম দেয়া হয়েছে মৃত পাথর।।
এই নামগুলোও ইউটিউবারদের মুখরোচক গুজবের অন্যতম হাতিয়ার।তারা পাথরগুলোকে জীবন্ত দাবি করেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ringing_rocks
এই ছিল ইউটিউবার মহাশয়ের অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।রহস্যগুলো সবই মীমাংসিত,শুধুমাত্র ইউটিউবারদের কাছে অমীমাংসিত।নাহলে যে তাদের ভাঁওতাবাজি দিয়ে ভিউ কামানো বন্ধ হবে না!
এভাবে দেশি ইউটিউবাররা দিনের পর দিন বোকা বানিয়ে যাচ্ছে দেশের সহজ সাধারণ মানুষকে।এদের বানানো মিথ্যাচারমূলক ভিডিও দেখে লোকজন বিভ্রান্ত হয়।ফলে "জাস্ট থিওরি" কিংবা "বিজ্ঞান জানে না" টাইপের কথা প্রায়ই শোনা যায়।
তাই আসুন,সবাই কোনো তথ্য বিশ্বাস করার আগে যাচাই করতে শিখি।যা দেখি তা যাচাই না করেই বিশ্বাস করার মনোভাব বাদ দেই।
আসুন সবাই মিলে সমস্বরে এই প্রতিপাদ্য নিয়ে চলি-
"বাঁচতে হলে ভাবতে হবে।"
তাজউদ্দিন আহম্মদ
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন