নিউটনের আপেলের গল্পটি বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগুলোর একটি। তবে এটি যেভাবে ছড়ানো হয়েছে আসলে তেমন নয়। লন্ডনের রয়াল সোসাইটির পুরোনো আর্কাইভ ঘেঁটে একটি পান্ডুলিপি উদ্ধার করা হয়েছে যাতে আপেল বিষয়ক একটি ঘটনার উল্লেখ ঠিকই আছে।
রয়্যাল সোসাইটি ২০১০ সালে এই পান্ডুলিপিটি সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করে এবং তারপরই প্রকৃত গল্পটি সবাই জানতে পারে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে যে গল্পটি অনেকাংশেই সত্যি, তবে নিউটনের মাথায় আপেলটি পড়েছে এমন সম্ভবতঃ নয় যদিও গল্পটি এভাবেই ছড়িয়েছে।
এই পান্ডুলিপিটি নিউটনের জীবনী নিয়ে লিখেছিলেন তাঁরই একজন বন্ধু উইলিয়াম স্টাকেলি, পেশায় যিনি ছিলেন একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ।
মৃত্যুর এক বছর আগে, নিউটন সেই আপেলের গল্প করেছিলেন উইলিয়াম স্টুকলির কাছে। ১৭৫২ সালে প্রকাশিত “Memoirs of Sir Isaac Newton’s Life” নামে নিউটনের জীবনী বইটিতে উল্লেখ করেন সেই কথা। সে অনুযায়ী-
"ডিনারের পর আবহাওয়া গরম হয়ে পড়লে আমরা বাগানে গেলাম এবং আপেল গাছের ছায়ায় বসে thea (পানীয়) পান করলাম।
তিনি তখন আমাকে বললেন, ঠিক এরকম একটা অবস্থায় অনেক বছর আগে তিনি দেখেছিলেন একটা আপেল পড়তে গাছ থেকে। তখনই তার মাথায় এসেছিল ধারণাটি। 'কেন আপেলটা লম্বভাবে পড়লো মাটিতে? উপরে গেল না কেন? অথবা ডানে বায়ে? কারণ, নিশ্চয়ই পৃথিবী তাকে টানছে। তাহলে পদার্থের নিশ্চয়ই আকর্ষণ ক্ষমতা আছে... আর এটা নিশ্চয়ই ভরের উপর নির্ভর করে। সুতরাং আপেল যেমন পৃথিবীকে টানছে, তেমনই পৃথিবীও আপেলকে টানছে।'’ ” [১৫ এপ্রিল, ১৭২৬]
একই ধরনের বাক্যের সমাবেশে ভলতেয়ার তার "এসে অন এপিক পোয়েট্রি" (১৭২৭) নামক প্রবন্ধে লিখেছেন,
"আইজাক নিউটন যখন তার বাগানে হাটছিলেন. তখন গাছ থেকে একটি আপেলকে মাটিতে পড়তে দেখে প্রথম মহাকর্ষ পদ্ধতি সম্বন্ধে তার বোধদয় হয়।" এই বর্ণনাগুলো সম্ভবত কিছুটা অতিরঞ্জিত। কারণ নিউটনের নিজের বর্ণনা অণুযায়ী, তিনি উল্সথর্প ম্যানরে তার নিহের বাসার জানালার কাছে বসে ছিলেন। এমন সময় জানালা দিয়ে গাছ থেকে একটি আপেল মাটিতে পড়তে দেখেন।"
নিউটনের ভাইয়ের মেয়ের স্বামী এবং রয়েল মিন্টে তার সহকারী জন কন্ডুইট নিউটনের জীবনী লিখতে গিয়ে এই ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:
''১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নিউটন কেমব্রিজ ছেড়ে লিংকনশায়ারে তার মা'র কাছে চলে আসেন। সেখানকার বাগানে বসে একদিন তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এমন সময় তার মাথায় আসে অভিকর্ষ শক্তি (যা একটি আপেলকে গাছ থেকে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসে) পৃথিবী থেকে কেবল একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেনা। সাধারণত যেমনটা চিন্তা করা হয় এই শক্তি নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক দূরত্ব পর্যন্ত তার শক্তি বজায় রাখে। নিজের মনে তিনি বলে যেতে থাকেন, এই বলটি কেনইবা চাঁদ পর্যন্ত প্রসারিত হবেনা। আর সেক্ষেত্রে এটি চাঁদের গতিকে প্রভাবান্বিত করে এবং সম্ভবত তাকে কক্ষপথে স্থান করে দেয়ে। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি হিসাব করতে বসে যান যে, এই ধারণার ফলাফল কি হতে পারে।''
আসলে নিউটনের মাথায় কোনো আপেল পড়েনি। তবে হ্যাঁ, তিনি আপেল পড়া লক্ষ্য করেছিলেন। তার জীবনীকার ভলতেয়ার প্রথম লেখেন,
নিউটন আপেলের পতন দেখে অভিকর্ষ তত্ত্ব বুঝতে পারেন। কিন্তু, আসলে একটা মাত্র ঘটনা তাকে এঅ তত্ত্ব বুঝতে সাহায্য করেনি। বরং এ ঘটনা হয়তো তাকে তার তত্ত্ব সম্পূর্ণ করার দিকে এগিয়ে নিয়েছিল। এটা ছিল একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নিউটন কিন্তু প্রায়ই এ আপেলের ঘটনার উদাহরণ দিতেন, কারণ এটা দিয়ে সহজে বোঝানো যেত তার তত্ত্ব।ওনি এত জটিল ক্যালকুলেশন না যেয়ে সরল উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন।
তবে আপেল অর্থাৎ, আপেল তো ঠিকই পড়েছিলো, কিন্তু নিউটন আপেল মাটিকে পতনের আরো আগে থেকেই মহাকর্ষ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেন।আপেলের মাটিতে পতন তার চিন্তাটাকে এগিয়ে নিতে প্রভাবিত করতে পারে এই-ই যা।
কিন্তু তার মাথায় আপেল পড়েছে এটা তার কোনো নোটপত্র, ডায়েরি ঘেটেও কেউ পায়নি।
তিনি দীর্ঘদিন থেকে মহাকর্ষ নিয়ে ভেবেছেন, ভেবেছেন কেন কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে সেটা নিচের দিকেই নামে, উপরের দিকে উঠে যায় না। কোনো বস্তুকে শুন্যে ছেড়ে দিলে সেটা যে মাটিতে এসে পড়ে সেটা প্রত্যেক মানুষই পর্যবেক্ষণ করেন। সৃ্ষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ দেখে আসছে কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে সেটা নিচে পড়ে যায়। নিউটনের মাথায় যদি আপেল পড়েও থাকে তাহলেও সেটা নিশ্চয়ই তাঁর জন্য নতুন ঘটনা ছিলো না। এর আগেও তিনি বিভিন্ন বস্তুকে নিচে পড়তে দেখেছেন। নিউটন এতটা নির্বুদ্ধি ছিলেন না যে একদিন হঠাৎ একটি আপেল পড়ায় তাঁর মনের হলো আপেল নিচে নামল কেন? আপেল উপরে উঠে গেল না কেন? প্রকৃত যে ঘটনাটি ঘটেছিলো বলে সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য তা হচ্ছে তিনি কোনো এক আলোচনায় মহাকর্ষসূত্রটি বোঝাছিলেন। সেই আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি আপেল গাছ থেকে আপেল পড়ার উদাহরন টেনে আনেন। তিনি ব্যখ্যা করেন এভাবে
“আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম কেন আপেল গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়ে ………..”।
সো, নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছে যারা বলেন তাদের মাথায় আপেল গাছ গজাবে ভবিষ্যতে সেটা নিশ্চিৎ থাকতে পারেন।
আরো একটা কথা- একটা বড়সড় আপেল লম্বা গাছের ওপর থেকে কারো মাথায় পড়লে তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবার কথা। আঘাত গুরুতর হতেও পারে। ওই অবস্থায় কারো বিজ্ঞানের সূত্র মাথায় আসে কিভাবে??
(এই গাছের একটি বংশধর কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের প্রধান ফটকের পাশে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। নিউটন ট্রিনিটি কলেজে অধ্যয়নকালে যে কক্ষে থাকতেন তার ঠিক নিচেই গাছটি অবস্থিত।)
সোর্স :
1.
2.https://www.google.com/amp/s/www.newscientist.com/article/2170052-newtons-apple-the-real-story/amp/
3.https://www.google.com/amp/s/www.independent.co.uk/news/science/the-core-of-truth-behind-sir-isaac-newtons-apple-1870915.html%3famp
4.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Isaac_Newton
আবু রায়হান
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান
Newton er mathai kokhon apple porechilo
উত্তরমুছুন