কান নিয়েছে চিলে: কিছু গুজবের গল্প


 লেখাঃ জহিরুল ইসলাম 


১. 


ভারতের ক্রিমিনালদের মধ্যে একটা বড় ক্রাইম- শিশু ধর্ষণ।


সমাজবিজ্ঞানীরা অনেক গবেষনা করলেন। এডুকেশন, মেন্টালিটি, জেনেটিক ফ্যাক্টর, এনভারনন্টাল ফ্যাক্টরের পাশাপাশি অস্বাভাবিক যে কারনটা তারা খুজে পেলেন , সেটা হচ্ছে এডাল্ট সাহিত্য (পানু বা চটি বই নামে যেগুলো বেশি পপুলার)। 


কোলকাতা থেকে প্রকাশিত চটি সাহিত্যের বইগুলাতে বলা হয়েছে, ভার্জিন মেয়ের সাথে যৌন মিলন করলে যেকোনো যৌন রোগ দূর হয়ে যায়। বাংলা চটি বইয়ের এই কথা বিশ্বাস করার ফলে অপরাধীরা কম বয়সী মেয়েদের সাথে কোনো ধরনের  সুযোগ পেলেই নিজেদের যৌন রোগ সারানোর চেষ্টা করে। ফলে কোলকাতায় শিশু ধর্ষনের পরিমান বেশি হচ্ছে । ভারতের অন্য এলাকায় এই ধরনের কুসংস্কার চালু না থাকার কারনে শিশু ধর্ষন তুলনামূলকভাবে কম । 


(সোর্স-  https://www.bbc.com/bengali/news-43849681) 


২.


------------


৩.


ভৌতিক/হরর বইতেও অনেক ধরনের ভুল ইনফর্মেশন থাকে, যে তথ্যগুলো থেকে মানুষ মিসগাইডেড হতে পারে। শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বিলাসী গল্পে এবং শ্রীকান্ত উপন্যাসে লেখক স্বীকার করেছেন যে, সাপুড়ের মন্ত্র কিংবা তাবিজের কোনো পাওয়ার নেই , এইগুলা মানুষ ঠকানোর ধান্দা। 


কিন্তু অনীশ দাস অপু বা রহস্য পত্রিকার অন্যান্য হরর লেখকের গল্পে দেখা যায়, সাপুড়ে (কিংবা অন্যান্য অসীম ক্ষমতাধর ম্যাজিশিয়ানরা)  তাবিজ দিয়ে বিষ সারাতে পারেন, বাশি বাজিয়ে সাপ ডেকে আনতে পারেন (যদিও, সাপের আসলে কান নেই, সে কোনো শব্দ শোনে না :) ) শত্রুকে বান মারতে পারেন, ব্ল্যাক ম্যাজিক দিয়ে যে কোনো লোকের মৃত্যুও ঘটাতে পারেন । 


 অনেকেই এই সকল বইয়ের গল্প বিশ্বাস করেন, ব্ল্যাক ম্যাজিক দিয়ে নিজের উদ্দিষ্ট কাজ করতে চান। ফলে হাটে মাঠে ঘাটে বাজারে অনেক জ্যোতিষ সম্রাট ,কবিরাজ, তান্ত্রিক, সাধু,সন্যাসী,ফকির, দরবেশকে দেখা যায় ; যারা মানুষের কাছ থেকে টাকা শুষে নেয়। ঢাকার বসুন্ধরা সিটির মত পশ এলাকাতেও যেমন এইসকল বাবার চেম্বার রয়েছে


 ( জ্যোতিষ লিটন দেওয়ান চিশতী, শেষ দর্শন আজমেরী জেমস হাউ্‌ দোকান নং ৭০, ৭১ ব্লক ডি, লেবেল-১ বসুন্ধরা সিটি  https://www.chandpurnews.com/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7-%E0%A6%A0%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8B/) 


 তেমনি কুমিল্লা ভার্সিটির মেইন গেটের পিলারেও কামরুপ কামাখ্যা থেকে প্রশিক্ষিত তান্ত্রিকের পোস্টার দেখা যায়।


 দেশের সব জায়গার সব পেশার লোকদেরকেই এরা প্রতারিত করে নিজেদের পকেট ভরে। 


গল্প বাদে, শুধুমাত্র মন্ত্র ওয়ালা বই ও বাজারে বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। কোকা পন্ডিতের বৃহত ইন্দ্রজাল কিংবা আসল লজ্জাতুন্নেছা নামক কথিত "ব্ল্যাক ম্যাজিক" এর বই বাজারে পাওয়া যায়। এসব বইয়ে বর্নিত মন্ত্র কোনোটা কাজ করে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। তবে এসব বইয়ে বর্নিত উপায় ফলো করে অনেকেই ভয়ংকর ভয়ংকর কান্ড ঘটাচ্ছে । 


একটু খুজলেই আপনার আশেপাশে ব্ল্যাক ম্যাজিকের ক্ষমতায় বিশ্বাসীদের ঘটানো ভয়ংকর কর্মকান্ড দেখতে পাবেন। 


৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ গভীর রাতে ঢাকার পোস্তগোলা শ্মশান থেক ৫ কিশোরকে আটক করা হয়। তারা একটি মৃত শিশুর শরীর থেকে মাথা কেটে নিয়ে, মাথায় রং মাখিয়ে, সেটা দিয়ে পূজা করছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ইন্টারনেট থেকে তারা জেনেছে যে এইভাবে শিশুর মাথা দিয়ে পূজা করলে অলৌকিক ক্ষমতা পাওয়া যায় 


( নিউজ লিংক- https://www.prothomalo.com/amp/story/bangladesh/crime/%E2%80%98%E0%A6%85%E0%A6%B2%E0%A7%8C%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B6%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E2%80%99-%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B6-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE)


গত ২৭শে মে ভারতের উড়িষ্যার সনসারী ওঝা তার বন্ধু সরোজ কে ডেকে এনে তাকে খুন করেন। খুন করার পরে তার কাঠা মুন্ডু দিয়ে সারারাত মন্দিরে পূজা করেন। কারন,তার বিশ্বাস অনুযায়ী, এইভাবে নরবলি দিয়ে তার মাথা দিয়ে পূজা করলে সারা বিশ্ব থেকেই করোনা রোগ চলে যাবে। 


( নিউজ লিংক - https://eisamay.indiatimes.com/nation/to-fight-against-coronavirus-elderly-man-chops-off-mans-head-in-odisha/amp_articleshow/76070315.cms) 


এইরকম হাজার হাজার "ব্ল্যাক ম্যাজিক" এ বিশ্বাসী লোক পাওয়া যাবে,  যারা এমন ভয়ংকর কান্ড কারখানা করে বেড়াচ্ছেন। ব্ল্যাক ম্যাজিকের কোনো ক্ষমতা থাক বা না থাক, এই বিশ্বাসীদের কাজকর্ম কিন্তু থেমে নেই। এবং, তাদের বিশ্বাস জন্মেছে ভূত সম্পর্কিত বিভিন্ন বই পত্র, অনলাইন পেজ কিংবা ভূত এফ এম এর মত রেডিও শো থেকে। 


সলুশন কি হওয়া উচিত? আইন করে ব্ল্যাক ম্যাজিকের গল্প ওয়ালা বই নিষিদ্ধ ? কিংবা সঠিক তথ্য ওয়ালা বইয়ের পাবলিকেশন ? ১ এবং ২ নাম্বার টপিকের ক্ষেত্রে যেভাবে দাবি ওঠে বইগুলা নিষিদ্ধের, ভূতের বইয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু সেইরকম দাবি শোনা যায়না । 


৪. 


বিজ্ঞানের নাম নিয়ে অপবিজ্ঞান লেখা প্রচুর বই আছে । জুল ভার্ন , এইচ জি ওয়েলস বা আইজ্যাক আজিমভ রা যখন সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, তখন কিন্তু তারা সায়েন্সের কোনো সূত্র ভেংগে নতুন করে বই লিখেনি। তাদের সায়েন্স ফিকশনে মানুষ চাদে গেছে, কিন্তু মানুষ মাধ্যকার্ষন শক্তি উপেক্ষা করে হেটে হেটে যায়নি চাদে, রকেটে গেছে। তাদের সায়েন্স ফিকশনে রোবটগুলা অনেক বেশি মানুষের মত দেখতে, মানুষের মত ইমোশন ও আছে তাদের, কিন্তু তাদের রিপ্রোডাকশন পাওয়ার নেই। 


পরবর্তী প্রজন্মের সায়েন্স ফিকশন লেখকরা জিনিসটাকে নষ্ট করে ফেলেছে। এখনকার সায়েন্স ফিকশনে টেলিপ্যাথি দিয়ে শত্রুরা মাইন্ড কন্ট্রোল করে, মরে যাওয়ার পরেও প্যারালাল ইউনিভার্সে গিয়ে জীবন ফিরে পাওয়া যায়, হাইপার ডাইভ দিয়ে কোটি কোটি লাইট ইয়ার দূরের গ্রহে পৌছানো যায়, আলোর চেয়ে দ্রত গতিতে যাওয়া যায় কিংবা বিরামহীনভাবে কারেন্ট পাওয়া যাবে এইরকম মেশিন বানানো যায়। এইসকল গল্প পড়ে বাচ্চারা কি শিখবে? যদিও এখান থেকে খুন ধর্ষনের মত ঘটনা ঘটার চান্স কম, কিন্তু প্রকৃত সায়েন্স না শিখে তারা অনেক সময়েই সিউডো সায়েন্স কে সত্যিকার সায়েন্স ভাবতে পারে। 


মুহম্মদ জাফর ইকবালের বেজি নামক বইয়ে 'স্ক্রিন সেভার' নামে একটা ছোট গল্প আছে । (ডাউনলোড লিঙ্ক - http://books.shishukishor.org/2016/06/blog-post_51.html) 


এই গল্পে দেখা যায় এক কিশোরের কম্পিউটারের একটা স্ক্রিন সেভার বাচ্চাটাকে হিপনোটাইজ করে ফেলে। এর পর বাচ্চাটা মাঝে মাঝেই স্ক্রিন সেভারের দিকে তাকিয়ে থাকে, স্ক্রিন সেভার তাকে যে সিগনাল দেয় , সেই অনুযায়ী সে কাজ করে। মানুশকে খুন করার চেষ্টা করে। 


মানুষজন এই সব গাজাখুরি গল্পের কোনো প্রতিবাদ করেনি, আমরা এই সব গল্প বিশ্বাস করেই বড় হয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল, যখন একবারে পুরা দেশ প্যানিক করল ব্লু হোয়েল গেমসের নামে। যে গেম মোবাইলে ইন্সটল করলে সেই গেম অথরিটি আপনার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিবে এবং আপনাকে মেরে ফেলবে। পুরা জাতি একসাথে এতটা পাগল হয়ে উঠেছিল যে হাইকোর্ট অর্ডার দিল যেন ব্লু হোয়েলের লিঙ্ক বন্ধ করে দেওয়া হয় (ব্লু হোয়েল নামে কখনো কোথাও কিছু নেই, ছিল ও না, বন্ধ করবে কি !!!) 


বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন পর্যন্ত ১৬০০ সেঞ্চুরিতে এই সিউডো সায়েন্সের কবলে পড়েছিলেন। তাকে একজন আলকেমিস্ট ব্রেইন ওয়াশ করেছিল যে , চলো আমরা পরশ পাথর তৈরি করি (এমন পাথর, যা দিয়ে যে কোনো বস্তু টাচ করলে সেই বস্তুটা সোনা হয়ে যাবে) 


নিউটন ও সেই আলকেমিস্টের কথা বিশ্বাস করে কয়েক বছর ধরে ল্যাবে সময় দিয়ে পরশ পাথর তৈরির বৃথা চেষ্টা করলেন ।  এই কয়েক বছর যদি তিনি মূল বিজ্ঞানের সেবায় ব্যয় করতেন তাহলে হয়তো আমরা আরো বেশি কিছু পেতাম তার কাছ থেকে। 


অথচ, এই  আলকেমি বিদ্যার কথা এখনো আমাদের বইতে লেখা হচ্ছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর নিঃসংগতার একশো বছর কিংবা পাওলো কোয়েলহোর দ্য এ্যালকেমিস্ট বইতে এমনভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যেন এইরকম ভাবে পরশপাথর তৈরি করা আসলেই সম্ভব। 


( বিস্তারিত - https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1587051278137882&id=100004990757830) 


নিশ্চিতভাবেই অনেক স্বপ্নবাজ তরুন এইসব গল্প পড়ে মোটিভেটেড হয়ে অনেক অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এই সময়গুলা "কান চুরি করে নেওয়া চিলের পিছনে" না দৌড়ে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক গবেষনার পেছনে ব্যয় করলে অনেক উপকার হত। 


এই ভুয়া বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলা নিষিদ্ধ না করার পক্ষে কোনো যুক্তি আছে? 


৫.


ইদানিং আরেক ধরনের বই বাজারে খুব চলছে। দর্শন,ইতিহাস, আর্কিওলোজি, সাইকোলজি , ধর্ম, টেকনোলজি ,জিওগ্রাফি--সব কিছুর খিচুড়ি এই বইগুলা। অধিকাংশ বইই অনুবাদ, যাদের মধ্যে সবচেয়ে পপুলার হচ্ছেন ড্যান ব্রাউন। এদেরকে নকল করে, (সরি ,আই মিন , ড্যান ব্রাউন দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে)কয়েকজন বাংলায় মৌলিক গল্প ও লিখছেন। 


  টর্চ লাইটের ক্ষীন আলোয় যারা ভাল দেখতে পায়, তাদের চোখে স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইট পড়লে যে অবস্থা হয় --এই বইগুলার সামনে আমাদের অবস্থা সেইরকম। এত এত বস্তা ভর্তি ইনফর্মেশন আমাদের সামনে হাজির করে যে, আমাদের চোখ ধাধিয়ে যায়। হাজার হাজার সত্য ইনফর্মেশনের মধ্য থেকে ১/২ টা ভুল ইনফো যদি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, আমরা সেগুলোও বিশ্বাস করে ফেলি। ড্যান ব্রাউনের দ্য ভিঞ্চি কোড বইতে যিশুর জন্ম, মৃত্যু পরবর্তী পলিটিক্স, রোমান রাজা, ভ্যাটিকানের ক্ষমতা, যিশুর বিয়ে, তার বংশধর ইত্যাদি নিয়ে অনেক তথ্যই আছে। শুধু যেটা বলা নেই, তা হচ্ছে প্রায়রি অফ সায়ন নামক সংঘের অস্তিত্ত্ব একটা গুজব, এর সত্যতা নেই। বইটা পড়ে সবারই ধারনা হবে, যিশুর বংশধররা এখনো বেচে আছে, তারা বিভিন্ন চিপায় চাপায় লুকিয়ে থেকে অনেক কিছুই করতেছে। 


একই অবস্থা তার এঞ্জেলস এন্ড ডেমন্স নামক বইতে। বইয়ের সব ইনফর্মেশনই ঠিক আছে, শুধু যেটা বলা নেই তা হল ইলুমিনাতি নামক সংগঠনটা ১৬০০ সালেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এখন আর এর অস্তিত্ত্ব নেই। 


যে কোনো ঘটনায় ইলুমিনাতির ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসীর সংখ্যা এখন বাংলাদেশেও কিন্তু কম নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশন থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস -- সব কিছুর পেছনেই তারা ইলুমিনাতির ষড়যন্ত্র দেখে। 


৬. 


যে সকল বইতে ধর্ম,যৌনতা কিংবা পলিটিক্স বিষয়ে জনগনকে মিসগাইড করার চান্স আছে, সেই সকল বই সরকার উদ্যোগী হয়ে নিষিদ্ধ করে দেয় । সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক ও হয় অনেক সময়। অতি সম্প্রতি 'বিষফোড়া' নামক একটি বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 


কিন্তু, বিজ্ঞান, ভূত কিংবা ইতিহাস বিষয়ে যে সকল বই ভুল তথ্য দিচ্ছে, তাদের ব্যাপারে কি করা উচিত ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন