আবু রায়হান
বাদুড় নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত আমাদের মাঝে। চলুন সেসবের মাঝে ৫টি গুজবের মূল সত্যতা যাচাই করা যাক।
১. বাদুড় কি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী?
২. বাদুর কি শুধু শব্দ তরঙ্গ দিয়েই চলাচল করে?
৩. কেন রাতেই বেশি চলাচল করে?
৪. বাদুড় কি মুখ দিয়েই মলত্যাগ করে?
বাদুড়ের কি মলদ্বার নেই?
৫. বাদুড় কি মুখ দিয়ে মল ত্যাগ করে?
১. বাদুড় কি চোখে দেখেনা?
সবাই বলে, বাদুড় পুরোই দৃষ্টিহীন, শব্দতরঙ্গ অনুসরণ করেই তার সব ওড়াউড়ি। বাদুড়ের শ্রবণশক্তি প্রচণ্ড প্রখর, সত্যি। তবে এ কথাটা একদম ঠিক নয় যে বাদুড় চোখে দেখে না। কিছু বড় বাঁদুরের দর্শন ক্ষমতা ত আমাদের চেয়েও বিশগুণ বেশি এবং রাতে ১কিমি পর্যন্ত দেখতে পারে।
মেরু দেশ ও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছাড়া সারা বিশ্বে বাদুড় দেখা যায়। পৃথিবীতে তালিকাভুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী-প্রজাতির ২০ শতাংশ বাদুড়। বিজ্ঞানভিত্তিক সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে—১১০০ প্রজাতির বাদুড়ের সবাই দেখতে পায় আর তা ভালোভাবেই; নিশাচর অনেক প্রাণীর মতো দৃষ্টিশক্তিটা তাদের ততো প্রখর না, এই যা। প্রধানত দুটি গোষ্ঠী বাদুড়ের—মেগাকিরোপেটরা ও মাইক্রোকিরোপেটরা। প্রথমটি আকারে মাঝারি থেকে বড়। দৃষ্টিকেন্দ্র শক্তিশালী, চোখ বড়সড়। শিকারের সময় গন্ধ ও দৃষ্টিশক্তি দুটিই এরা ব্যবহার করে।মানে এরা শব্দের প্রতিধ্বনির পাশাপাশি এরা চোখও পথ চলতে ব্যবহার করে।
তাছাড়া ফ্লাইং ফক্স জাতের বাদুড়ের কথাই যদি ধরি, ওরা দিনের আলোয় শুধু ভালো দেখতেই পায় না, পৃথক পৃথক রঙেই সব দেখে। সত্যি বলতে, দিনের আলোই ওদের প্রধান প্রাণশক্তি। চাঁদহীন ঘুটঘুটে রাতে মেগাকিরোপেটরা উড়তেই পারে না। ‘বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু/আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু। আজকে হেথায় চামচিকে আর পেঁচারা/ আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।’ সুকুমার রায়ের ছড়ার এই চামচিকেই আমাদের দ্বিতীয় গোষ্ঠীর বাদুড়-মাইক্রোকিরোপটেরা। এরা মূলত পতঙ্গভোজী, ক্ষুদ্রাকায়। স্তন্যপায়ী চোখের রেটিনায় দুই ধরনের আলোকগ্রাহী কোষ থাকে—দিনে ও রং দেখার জন্য কোণ, নৈশ দর্শনের জন্য রড। এই সেদিনের ধারণা ছিল নিশাচর মাইক্রো বাদুড়ের শুধুই রড থাকে, কোণ নেই। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, নাজুক, ছোট্ট চোখ দিয়েও এই বাদুড় দিনে দেখতে পায়। অন্ধকার নামলেই শিকারে বেরোতে হবে। তাই আলো-আঁধারির হিসাবটাও এদের ভালোই জানা। কাছাকাছি ওড়ার বেলায় নিজেদের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনলেই চলে তাদের। এই চলার সময় শব্দ করে ওড়ে বাদুড়, যাতে সামনে কোনো বাধা থাকলে কতখানি দূরত্বে আছে, কোন দিকে যেতে হবে—এসব বোঝা যায়। গাঢ় অন্ধকারে চুলের মতো সরু পদার্থকেও বুঝতে পারে বাদুড়। আবার তা শনাক্ত করে এড়িয়েও চলতে জানে। দূরের পথ পাড়িতে চোখ অবশ্যই ব্যবহার করা লাগে।
রব মিয়েস। মিশিগানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অর্গানাইজেশন ফর ব্যাট কনজারভেশনের নির্বাহী পরিচালক। মিয়েস ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সাময়িকীকে বলেন, ‘ Blind as a bat’ বলার দিন শেষ। বড়সড় বাদুড় মানুষের চেয়েও প্রখর দৃষ্টিশক্তি রাখে। সেই সঙ্গে শব্দ ধরে পথচলায়ও বাদুড়ের জুড়ি নেই।
দিনের বেলা কিংবা যখন পর্যাপ্ত আলো থাকে দেখার কাজে বাদুড় তাদের চোখ যথার্থভাবেই ব্যবহার করতে পারে।তাই বাদুড় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী—কথাটি ডাহা মিথ্যা। এদের প্রতি অপবাদ একরকম।
জাতগতভাবেই অন্ধ এমন কোনো বাদুড় কোথাও নেই।বাদুরের ১৩০০+প্রজাতির মধ্যে কোনোটাই অন্ধ নয়। দৃষ্টিশক্তির পার্থক্য কম বেশি আছেই,তবে পুরোপুরি অন্ধ নয়।
তাছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতির তারতম্যের ফারাকে কোনো কোনো বাদুড় চোখ বেশি ব্যবহার করে, কেউ করে একটু কম। এদেরও পৃথিবীতে রং আছে। এরা সে রঙে সব কিছু রঙিন দেখে। এদেরও ভুবন আলোয় ভরা।
২. বাদুড় কেন রাতে চলাচল করে?
বাদুড় রাতে চলাচল করার সময় মুখ দিয়ে শিষ দেয়, শিসের শব্দ সামনের কোন বস্তুুতে লেগে বাদুড়ের কানে ফিরে আসে, সেই শব্দ বিশ্লেষণ করে সেই বস্তুুর নিখুঁত অবস্থান জানতে পারে। এই ঘটনাকে ইকোলোকেশন বলে।
বাদুড় তার শব্দ ছুঁড়ে দেওয়ার কতক্ষণ পর সেটা আবার কানে ফিরে আসে তার ওপর নির্ভর করেই বাঁদুর বাধা ও খোলা পথের নিশানা ঠিক করতে পারে। বাদুড়ের মস্তিষ্ক এখানে সূক্ষ্ম কম্পিউটারের মতো কাজ করে। কারণ সামনের বাধার দূরত্ব কত সেটা বুঝতে অবশ্যই শব্দের বেগ ব্যবহার করতে হয়। বাদুড়ের মস্তিষ্ক নিশ্চয়ই সেটা জানে। মুহূর্তের মধ্যে শব্দের বেগ, দূরত্ব আর সময়ের মধ্যে সঠিক অঙ্ক কষে সঠিক নিশানা ঠিক করতে পারে সে।
দিনের বেলায় মানুষসহ পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণীই জেগে থাকে। তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের দরুণ কোটি কোটি শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। দিবাচর প্রাণীদের কোলাহলে বাদুড়ের পথচলার সেই বিশেষ শব্দ তরঙ্গ হারিয়ে যায়। তাই কোটি কোটি শব্দ তরঙ্গের ভিড়ে নিজের শব্দ তরঙ্গটি খুঁজে খুঁজে পায় না বলেই বাদুড় দিনের বেলা বাসা ছেড়ে বের হয় না
৩. কেন বাদুড়ের শব্দ শুনতে পাই না?
বাদুড়ের শ্রবণ ক্ষমতা শ্রাব্যতার পাল্লায় একলক্ষ হার্জ।আর আমাদের শ্রাব্যতার সীমা ২০-২০,০০০হার্জ। মানে এ সীমার হার্জের মধ্যে আমরা কোনো শব্দ শুনতে পাবো।
বাদুড় পথচলার জন্য এক ধরণের শব্দ তরঙ্গ বাতাসে ছুঁড়ে মারে। যা আমরা শুনতে পাই না। রাতে পেয়ারা বা লিচু গাছে আক্রমণ করলে হয়তো বাদুড়ের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়। কিন্তু সেটা ওদের পথ চলার শব্দ নয়, ওটা ওদের সাধারণ ডাক। পথচলা ও খাদ্য খোঁজার জন্য বাদুড় ইনফ্রাসনিক কিংবা আল্ট্রাসনিক শব্দ ব্যবহার করে। এসব শব্দ আমাদের কান ধরতে পারে না। তাই সেসব শব্দ মানুষের শুনতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ইনফ্রাসনিক শব্দের হার্জ ২০এর নিচে যা আমাদের শ্রাব্যতার সীমার বাইরে।
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, বাদুরের এই শব্দ এতই তীক্ষ্ম যে, তা আমাদের কানের পর্দায় আঘাত করলে কানের পর্দা ছিড়ে যাবে। কিন্তু বাদুরের শব্দ ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিত থাকে বলেই আমরা সে শব্দ শুনতে পাই না।
বাদুড় মূলত ফলভোজি। পেয়ারা, লিচু, জামরুল ইত্যাদি ফলের ঠিকানা খুঁজে বের করতে তারা শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে নাকের গন্ধ শক্তির ওপরও নির্ভর করে।
৪. উল্টো হয়ে ঝুলে কেন?
বাদুড় কিন্তু স্তন্যপায়ী জীব বাট পাখি কিংবা পোকা নয়।তাই তাদের পেশি,হাড়,টেন্ডন সামগ্রিক স্ট্রাকচারই পাখি বা পোকা থেকে কিছুটা ভিন্ন।
বাদুড়ের উড্ডয়ন করাটা পাখির মত এত সহজসাধ্য নয়।
পাখিরা মাটিতে বসে থাকলে স্থিরাবস্থা থেকেই পেছনের পায়ে বল প্রয়োগ করে বাতাসে উড্ডয়ন করতে পারে এবং বায়ুথলি ও শক্তিশালী উড়নক্ষম পাখা দিয়ে সহজেই উড়তে পারে। কিন্তু বাদুড়ের ক্ষেত্রে তা একটু কষ্টসাধ্য। পারেনা এমন নয় তবে তা পাখির তুলনায় বেশ কঠিন।
কারণ তাদের পেছনের পা তুলনামূলক বেশ ক্ষুদ্র যে কারণে তারা যে কোনোসময় চাইলেই উড্ডয়ন করার মত স্পিড তৈরি করতে পারেনা।ফলে তারা ডালে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। কারণ কখন কোন প্রাণী আক্রমন করে বসে,কখন না জানি আত্মরক্ষা করতে হয়।এখন যদি ডালে স্বাভাবিক পাখির মত শুয়ে থাকে বা বসে থাকে তবে তারা উড়াল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শারীরিক সক্ষমতা তৈরির পূর্বেই আরেক শত্রু প্রাণী বা শিকারীর আক্রমনের শিকার হতে পারে।মাটি থেকে আকাশে উড্ডয়ন করা আর ডাল থেকে উড্ডয়নে প্রায় একই শক্তি ও সক্ষমতার দরকার পড়ে যা তাদের যথেষ্ট পরিমাণে নেই।
তাই উল্টো হয়ে ঝুলে থাকাটাই তাদের গতিময় আত্মরক্ষার জন্যে পারফেক্ট পজিশন। তাই বাদুড়রা তাদের পায়ের শক্ত নখ দিয়ে ডালকে আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকে আর প্রতিকূল পরিস্থিতির স্বীকার হলেই নখ ছেড়ে দিয়ে উড়াল দিতে পারে।পেছনের পায়ের উপর উড্ডয়নের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি তৈরি করতে হয়না।জাস্ট নখের আচড় খুলে উড়াল দিলেই হলো।এভাবে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকাটা তাদের আত্মরক্ষা ব্যবস্থারই একটা অংশ।এর ফলে তারা যেকোনো সময় উড়াল দিতে প্রস্তুত থাকে।
১।https://www.mentalfloss.com/article/574568/why-do-bats-hang-upside-down
২।https://www.wonderopolis.org/wonder/why-do-bats-sleep-upside-down-
৫.
বাদুড় কি মুখ দিয়ে খায় আবার মুখ দিয়েই মল ত্যাগ করে?
বাদুড়ের পরিপাক তন্ত্রের শুরু হয় মুখ থেকে আর শেষ হয় পায়ু ছিদ্রে। এরা মানুষের মতই মুখ দিয়ে খায় আর পায়ু পথে মল ত্যাগ করে। অনেকে ধারনা করে বাদুড় উল্টা হয়ে ঝুলে মল ত্যাগ করে কিভাবে? তাই মুখ দিয়ে মল ত্যাগ করে??
আমরা মল ত্যাগ করার জন্য যেমন ল্যাট্রিন এ যাই তেমনই বাদুড় মলত্যাগ করার জন্য উড়ে বাইরে যায় তখন তার মুখ উপরের দিকেই থাকে এবং মলদ্বার থাকে নিচের দিকেই।
তাছাড়া উল্টো হয়ে ঝুলে থাকলেও মলত্যাগ করতে পারে।সেক্ষেত্রে তারা উল্টো হওয়ার অবস্থা থেকে কিছুটা স্থান পরিবর্তন করে স্বাভাবিক অবস্থানে বডিকে ঘুরায়।
মনে রাখবেন বাদুর যখন ঝুলে থাকে তখন দুটি পা দিয়ে ডাল আঁকড়ে ধরে এবং হাত দুটি উল্টে থাকে।
মলত্যাগ করতে চাইলে বাঁদুর তার উল্টা অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে এবং নিচে ঝুলে থাকা হাত দিয়ে উপরের ডালকে আঁকড়ে ধরে এবং মুখ উপরের দিকে এনে, মলদ্বার নিচের দিকে তাক করে মলত্যাগ করে দেয়।
তার মানে তখন বাদুড় পুরোপুরি উল্টে ঝুলে থাকেনা। কি ভদ্র তাই না।?তারপরেও তাদের নামে কত দুর্নাম!!
তাহলে এ মিথ কিভাবে বিস্তার পেলো?
আসলে বাদুড়দের আমাদের মত ফাইবার হজম করার তেমন ক্ষমতা নেই।আমরা আমরা যেমন কোনো ফলের সবটাই খেতে পারি, বাঁদুর তেমনটা পারে না।বাঁদুর শুধু রসটাই খাবে,বাকিটুকু ছুড়ে ফেলে দিবে এ কারণে কিন্তু খেঁজুর রসেও তাদের উপস্থিতি দেখা যায়।বাদুরের হজম সময় খুব দ্রুত।প্রায় বিশ মিনিটের মত।ফলে এরা দ্রুত যতটুকু সম্ভব খাবার খায় এবং বাকিগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়।আর মুখ দিয়ে ছুড়ে ফেলাটাই আমরা মল হিসেবে ভেবে থাকি।অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মত বাঁদুরেরও মলদ্বার আছে যা দিয়ে বাঁদুর মল ত্যাগ করে। শুধু শুধ বেচারাটাকে আমরা এ অপবাদ দিচ্ছি আমাদের অজ্ঞানতার কারণে।
http://ipfactly.com/top-10-facts-about-bats/
https://batrescue.org.au/new/about-bats-2/myths-and-facts.html
★
বাদুড় মোটেই কিন্তু এত অপরিচ্ছন্ন নয়। বাদুড়ও বিড়ালের মত নিজের শরীর নিজে লেহন করে পরিষ্কার করে থাকে।
প্রায় ৩০০ প্রজাতির ফল পরগায়নের জন্য বাঁদুরের উপর নির্ভরশীল। বাঁদুর প্রচুর খেতে জানে এবং প্রাকৃতিক কৃষকের মত বনে বাদারে বীজ ছিটিয়ে, পরাগসংযোগ করে পরগায়নে সাহায্য করে।
একটি বড় বাঁদুর এক রাতে প্রায় ষাট হাজার বীজ ছড়িয়ে দিতে পারে।
তাছাড়া এরা মশা, মথ, পোকামাকড় খেয়ে পোকামাকড়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রন রাখতে ভূমিকা রাখে।
★বাদুড় মানেই কিন্তু রক্তচোষা নয়।
Blood-sucking বা, Vampire Bat কেবলমাত্র মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে দেখা যায়।এগুলো খুবই ছোট।৫০গ্রামের চেয়েও কম ওজন এদের প্রধান শিকার হলো গৃহপালিত পশুপাখি।
আবু রায়হান,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন