ক্রপ সার্কেল: যে রহস্য উদঘাটিত হয়েছে

তাজউদ্দিন আহমদ


শরতের শুভ্র সকাল।

ঘুরতে বেরিয়েছেন আপনি।

ফুরফুরে বাতাস,ক্ষেতের আল ধরে আপনি মনোমুগ্ধকর সকালে পরিবেশে গুণগুণ করে গাইতে গাইতে হেটে চলেছেন।হঠাৎ আপনার চোখে পড়ল কে যেন ধানক্ষেতের ফসলগুলোকে মুচড়ে অদ্ভূতুড়ে সব নকশা করে রেখেছে।

বিচিত্র সে সব নকশা।

বৃত্তাকার, ত্রিভুজাকার, চতুর্ভূজারকার,

পিরামিডাকার, ডিম্বাকার আরো কত কী।

কোনো কোনো নকশা এত পারফেক্ট শেপে করা যে দেখলে মনে জুড়িয়ে যায়।

অবাক হলেন আপনি। কে করেছে এসব? ভূত, এলিয়েন, কোনো উচ্চ মাত্রার জীব?

যাক, এসব ভেবে লাভ নেই। আমি আমার নতুন ইউটিউব ভিডিওর কন্টেন্ট পেয়ে গেছি। এখন মনগড়া কাহিনী বানিয়ে লোকের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হলো। মিলিয়ন ভিউ কামিয়ে নেয়া সময়ের ব্যাপার।

মুচকি হেসে বাড়ির পথ ধরলেন আপনি।

ক্রপ সার্কেল রহস্যের সূত্রপাতটা কিছুটা এমনই।ক্ষেতে বানানো অদ্ভূত সব নকশা,তার সাথে এলিয়েনের সংযোগ জুড়ে দিয়ে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের এক মহা ধাপ্পাবাজি।

চলুন, এর ইতিহাসটা জেনে নেই।


১৬৭৮ সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের এক পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়

মাটির উপর অদ্ভূত কিছু নকশার।

কেউ কেউ দাবি করেন, এটিই পৃথিবীর প্রথম ক্রপ সার্কেল ছিল। পরে এই বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে জানা যায় যে, এটা আসলে মাটির উপর কিছু প্রাচীন নকশা ছিল। তাই ক্রপ সার্কেলের ব্যাপারটি উড়িয়ে দেয়া হয় এবং বহুদিন সেটা চাপা পড়ে থাকে।

আধুনিক ক্রপ সার্কেল রহস্যের শুরু ৮০র দশক থেকে।ইংল্যান্ডে হঠাৎ এই ক্রপ সার্কেলগুলো উদয় হয়।

১৯৮০-৯০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের উইটশায়ারের গ্রামগুলোতে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে ক্রপ সার্কেল দেখা যায়।

বিচিত্র নিখুঁত জ্যামিতিক আকৃতিতে তৈরিতে নানান ধরণের নকশা।


ক্রপ সার্কেলগুলো এত বড়ো ছিল যে, বিমান থেকেও সেগুলো দেখা যেত।

মুখরোচক সংবাদ তৈরির বিষয়বস্তু পাওয়া গিয়েছে যেন।

এরিয়া ৫১, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো এলিয়েন সম্পর্কিত যেসব গুজব রটানো হয়েছে, তার মতো করেই এই ক্রপ সার্কেলগুলোকেও এলিয়েনের তৈরি বলে চালানো হয়।চারদিকে এগুলোর কথা ছড়িয়ে যায়। হোক্সাররা তাদের কারসাজি দেখায়।



উৎসুক লোকেরা ভিড় জমায়, নানা আকৃতির ক্রপ সার্কেলগুলো দেখার জন্য। কিন্তু রহস্যের কূলকিনারার ব্যাপারে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।


অনেক হাইপোথিসিস চলে আসে


এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল বিয়িং, এলিয়েনস, হায়ার ডাইমেনশনাল বিহিংস, গ্লোবাল সাইকিক পাওয়ার ভুগিচুগি।

মানুষ নাকি এসব সার্কেল তৈরি করতে পারে না।

কিছু লোক স্ব-উদ্যোগে ক্রপ সার্কেল বানানোর চেষ্টা করে প্রমাণ করতে চান যে,এগুলো মানুষের দ্বারাই বানানো।

তাদের চেষ্টা জলে যায়। ধাপ্পাবাজি চলতেই থাকে। কারণ তখন এগুলোর পেছনে আসলে কে দায়ী তা জানা যায় নি।

১৯৯১ সালে এসে জানা যায় আসল কাহিনী। দুজন আর্টিস্ট রড ডিকিন্সন এবং জন লুন্ডবার্গ স্বীকার করে নেন, তারা এসব ক্রপ সার্কেল বানাচ্ছিলেন।

এবং পরে আরো কিছু আর্টিস্ট যেমন উইল রাসেল ও রব ইর্ভিং এ ধরনের ক্রপ সার্কেল বানানোর কথা স্বীকার করেন।

পরে আরো অনেক লোক পাওয়া যায়, যারা এসব কান্ড করছিল।

কান্ট্রিসাইডগুলোতে রাতে ফসলের ক্ষেতগুলো নির্জন থাকত।অত রাতে কেই বা ক্ষেতে যাবে বলুন?

গ্রাম হওয়ায় সেখানে নজরদারিও তেমন ছিল না।এই সুযোগ এসব কীর্তি করে বেড়াচ্ছিল কিছু লোক।

তারা রশি, পাইপ, শাবল, তক্তা ও অন্যান্য যন্ত্রংশ ব্যবহার করে এমনভাবে ফসল মুচুড়ে ও ভেঙে সার্কেলগুলো বানাতেন, যেগুলোর অনেকগুলোতে কাঁচি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ত না।

কেউ তাদের আর্ট প্র‍্যাকটিসের অংশ হিসেবে এসব বানাচ্ছিলেন।

আবার কেউ ক্রপ সার্কেলের এসব কাহিনী শুনে ধাপ্পাবাজি চালু রাখার জন্য নিজেরাই এসব ক্রপ সার্কেল বানানো শুরু করেন,যাতে লোকেরা মনে করে এসব জায়গায় এলিয়েন এর যান(ইউএফও) ল্যান্ড করেছে।

কিছু লোককে শাস্তির আওতায়ও আনা হয়।

ক্রপ সার্কেলের রহস্য উদঘাটিত হয়।

এরপর মানুষের কাছে এটি আর অন্য যে-কোনো স্বাভাবিক বিষয়ের মতই মনে হয়। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় ক্রপ সার্কেল তৈরি করার প্রতিযোগিতা পর্যবত আয়োজন করা হয়। ১৯৯২ সালে ৩০০০ ইউরোর প্রাইজমানি জিতে নেন উইটশায়ার হেলিকপ্টার ইঞ্জিনিয়ার্সের একটি দল। তারা পিভিসি পাইপ, তক্তা, মই ও দড়ি ব্যবহার করে এসব সার্কেল তৈরি করেন যা কাঁচি দিয়ে কেটে তৈরি করা হয় নি। ওই প্রতিযোগিতা থেকে প্রমাণিত হয় যে এসব ইম্প্রেসিভ ক্রপ সার্কেল মানুষের দ্বারা সহজেই তৈরি করা সম্ভব।

২০০২ সালে ডিসকভারি এম আইটি স্টুডেন্ট দের দ্বারা তৈরিকৃত ক্রপ সার্কেলের ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে।।

দ্যা গার্ডিয়ান সহ বিভিন্ন পত্রিকায় নানা সময় এ স্টোরির আসল কাহিনী লেখা হয়।

এই মিস্ট্রি তো পৃথিবীবাসীর কাছে সলভড হয়ে যায়।

কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মহামান্য গুজব রচনাকারী, বিজ্ঞানকে ভুল প্রমাণকারী, এলিয়েন গবেষক ইউটিউবারদের কাছে এগুলো আজও যেন রহস্য। মানুষের কাছে এগুলোকে এলিয়েনের কারসাজি হিসেবে উপস্থাপন করে চোখে ঠুলি পড়িয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কামিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ ভিউ।

আজও দেশের অনেক লোকই জানে, ক্রপ সার্কেল এলিয়েনের তৈরি। এসব মানুষের কর্ম নয়।

হতেই পারে না!

রেফারেন্স :

1.https://en.m.wiiki/Crop_circle

2.https://www.livescience.com/amp/26540-crop-circles.html#aoh=16062290232053&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&amp_tf=From%20%251%24s

3.https://youtu.be/3pDmrWwPhpg

তাজউদ্দিন আহমদ
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন