গাজরের একনায়কতন্ত্র

তাজউদ্দিন আহম্মদ



গাজর।

শুনতেই চোখে ভেসে উঠে টুকটুকে কমলা রঙের সুস্বাদু এক মূলের ছবি। অন্যের রঙের গাজর তেমন দেখেছেন? ঠিক কয়জনে দেখেছেন? এমন লোক তেমন পাওয়া যাবে না।অন্তত আমাদের দেশে খুব কম লোকই হবেন। কেন কমলা রঙের গাজরের এই আধিক্য? এর পেছনে একটা ইন্টারেস্টিং কাহিনী রয়েছে। চলুন জেনে আসি সেটা।

একসময় কমলা,হুলুদ,বেগুনি,সাদা ইত্যাদি রঙের গাজর পাওয়া যেত। কোথায় গেল সেগুলো?

ষোড়শ শতকে ডাচরা স্প্যানিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত ছিল।যা তৎকালীন হেসববার্গ শাসকগোষ্ঠী দ্বারা স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস নামে শাসিত হতো। এরপর ডাচ বিদ্রোহ ঘটে।।এরপর নেদারল্যান্ডস একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি পায়।এর নায়ক ছিলেন উইলিয়াম হেনরি,প্রিন্স অব অরেঞ্জ।তিনি আততায়ী দ্বারা নিহত হন।

ডাচ কৃষকরা তার সম্মানে সপ্তদশ কমলা রঙের গাজর চাষ করা শুরু করে।

এরপর কমলা রঙের গাজরের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় এবং তা অন্যান্য রঙের গাজরের স্থান দখল করে নেয়।

অন্য রঙের গাজর হারিয়ে যায়।

ইন্টারেস্টিং কাহিনী,তাই না?

এই তথ্যটা সম্পূর্ন ভুয়া।

ডাচ কৃষকদের তাদের প্রিন্সের সম্মানে কমলা গাজর চাষ করার কোনো ডকুমেন্টারি এভিডেন্স নেই।কমলা রঙের গাজর তারা উদ্ভাবনও করেননি। এই গাজর এসেছিল বহু আগে।

গাজর প্রথমদিকে সাদা বা হলদেটে রঙের হত। এরপর তা পার্পল এবং হলুদে চেঞ্জ হয় যখন প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে পারস্য প্লাটিউ অঞ্চলে লোকজন প্রথম গাজর চাষ শুরু করে।এরপর সারা পৃথিবীতে গাজরের চাষ ছড়িয়ে পড়ে।গাজরগুলো প্রধানত দুটি ক্লাসিক গ্রুপে তে বিভক্ত ছিল।এশিয়াটিক গ্রুপ যেটি হিমালয় অঞ্চলের দিকে চাষ হতো,এবং ওয়েস্টার্ন গ্রুপ যেটি মধ্যপ্রাচ্য ও তুরষ্কের দিকে চাষ হতো।ওয়েস্টার্ন গ্রুপের হলুদ গাজরগুলো মিউটেটেড হয়ে কমলা রঙ ধারণ করে।

প্রিন্স অফ উইলিয়াম আসার প্রায় ২০০ বছর পূর্বে কমলা গাজরের বীজ ইন্ট্রোডিউস হয়েছিল।মুসলিম বণিক যারা অটোম্যান সাম্রাজ্যের নর্থ আফ্রিকান অঞ্চল ও লাইবেরিয়ান পেনিনসুলা অঞ্চলে বাণিজ্যযাত্রা করতেন তারাই চৌদ্দ শতকে প্রথম কমলা গাজরের বীজ ইউরোপে নিয়ে এসেছিলেন।এর অনেক ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট রয়েছে।

অর্থাৎ,ডাচরা কমলা গাজরের জাত উদ্ভাবনও করেনি কিংবা কমলা গাজর সপ্তদশ শতকেও আবিষ্কৃত হয় নি।

এবং,কমলা গাজর অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল।

ডাচ অঞ্চলের আবহাওয়া এই গাজর চাষের জন্য অনেক উপযোগী ছিল এবং তারা তখন থেকেই বহুলভাবে এই গাজর চাষ শুরু করে। অর্থাৎ প্রিন্স অফ উইলিয়াম আসার প্রায় ২০০ বছর পূর্বে। পরবর্তীতে এই গাজর পুরো কন্টিনেন্টে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য কন্টিনেন্টেও ছড়িয়ে পড়ে।


সুতরাং সারসংক্ষেপ কি পাওয়া গেল?

কমলা গাজরের আধিক্যের সাথে প্রিন্স অফ অরেঞ্জ উইলিয়ামের কোনো যোগাযোগ নেই।তিনি আসার অনেক বছর পূর্বে ডাচ অঞ্চলে কমলা রঙের গাজর এসেছিল এবং তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।


প্রিন্স অফ অরেঞ্জের সাথে এই গাজরকে মেলানো আরেকটা মুখরোচক মিথ তৈরি করার প্রচেস্টা ছাড়া আর কিছুই না।

কারণ,

মুখরোচক কাহিনী মানুষ বেশি গিলে।গুজব বেশি খায়।এসব কাহিনী ছড়ালে প্রচুর পাবলিক রেসপন্স পাওয়া যায়।প্রচুর পরিমাণে বিস্ময় এবং ভালোবাসা পাওয়া যায়।

তাই,সাবধান।

বিস্ময় আর ভালোবাসা প্রদানের আগে একটু যাচাই করে নিন।


সোর্স:

https://www.livescience.com/why-are-carrots-orange.html

https://en.m.wikipedia.org/mythbuMyt


তাজউদ্দিন আহম্মদ

ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন