আবু রায়হান
এভাবে শুনে কী কী ভাবতেছেন?
ভাবতেছেন বোধহয় কোনো জীবিত সন্ন্যাসী বোধহয় মূর্তির ভেতর ধ্যানে মগ্ন তাই না?
নেদারল্যান্ডের দ্য মিয়েন্ডার মেডিক্যাল সেন্টারে প্রায় এক হাজার বছর বয়সি এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মূর্তি সিটিস্ক্যান করা হয়।
তা থেকে তারা জানতে পারেন যে বৌদ্ধ মূর্তির মধ্যে একটি মানবদেহ আছে |
এতদিনের মুখে মুখে প্রচলিত কথাটার সত্যতা বের করতেই এ আয়োজন।
সোনালি রঙের ওই ধাতব বৌদ্ধ মূর্তির সিটি স্ক্যান করার পরই দেখা যায় মূর্তির ভিতরে পদ্মাসনে ধ্যানে মগ্ন এক সন্ন্যাসী। নাম লিউকুয়ান।
ওই সন্ন্যাসীর দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ্য কিছুই নেই। অঙ্গের পরিবর্তে তার দেহের ভিতরে বৌদ্ধ ভাষায় লেখা কাপড় ভরা ছিল। কীভাবে তার দেহ থেকে সমস্ত অঙ্গ বের করে নেওয়া হল, কীভাবে তার মমি তৈরি হল তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
যাইহোক,
তারমানে মূর্তির ভেতরের বাহ্যিক ভাবে মনে হওয়া ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী যে মমিতে পরিণত হয়েছে তা শতভাগ নিশ্চিত।তারমানে তার দেহটা যে ধ্যানে মগ্ন সেট আপনি পুরোপুরি এভাবে বলতে পারেন না কারণ মমিটা ত মৃত। মৃত মমি ধ্যান করবে কীভাবে?
বরং শিরোনামটা এভাবে দিলে কনফিউশন সৃষ্টি হতো না-
"ধাতব মূর্তির মধ্যে ধ্যান মগ্নের মত দেখতে এক মমিফাইড সন্যাসী পাওয়া গেল"।
তারমানে মূর্তির ভেতরের সন্ন্যাসী জীবিত নয়,জাস্ট একটা মমি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা একে তাদের ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে জীবিত বলতেই পারেন -তা তাদের একান্ত ধর্মীয় ব্যাপার কিন্তু ঐ মমিটা জীবিত নয়।মমি জীবিত থাকা ত দূরের কথা ঐ মমির ভেতরে সজীব বা নির্জীব কোনো অঙ্গই নেই।
আর এখন পর্যন্ত শত শত মমি পাওয়া গেলেও কোনো জীবিত মমি পাওয়া যায় নি।তাহলে ঐ বৌদ্ধ মমিটাকে কোন লজিকে জীবিত বলে কিছু কিছু ফালতু গুজব মিডিয়া জীবিত বললো জানি না।কোনো সংবাদের ভেতরটা না পড়েই আমরা শিরোনাম দেখে প্রায়ই বিশ্বাস করে ফেলি। এ ট্রেন্ডটা বন্ধ করা উচিত।নতুবা হাস্যকর, অন্ধ জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে পরিচিত হয়ে যেতেও পারি।
নিজেই নিজের দেহের মমিফিকেশন জাপান,চীনের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে খুবই প্রচলিত প্রথা। এশিয়াজুড়েই এমন রীতির চল ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে। চীনেও এ রকম দেখা গেছে।
কীভাবে ধীরে ধীরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেদের দেহ মমি বানাতেন?
জেরেমিয়া কেন নামে এক লেখকের ‘লিভিং বুদ্ধা’ নামে বইয়ে এর উল্লেখ রয়েছে। ওই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এর পদ্ধতি।
ইচ্ছুক সন্ন্যাসীরা খুব কঠিন ডায়েট চার্ট অনুসরণ করে নাকি এমন করতেন।
বইতে দাবি করা হয়েছে, এটা খুব ধীর গতির প্রক্রিয়া। তারা বাদাম, বেরি, গাছের ছাল খেতেন। এতে নাকি ক্রমে তাদের শরীরের চর্বি গলে যেত এবং শরীর আর্দ্রতা হারিয়ে ক্রমশ শুষ্ক হয়ে উঠত।
মৃত্যুর পর শরীরে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি আটকাতে জীবিতাবস্থায় বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ খেতেন তারা। আর খেতেন বিশেষ এক ধরনের চা, যা বিষাক্ত হার্ব দিয়ে বানানো হত। এই চা পান করার ফলে তাদের শরীরও বিষাক্ত হয়ে উঠত এবং মৃত শরীরে ম্যাগট তৈরি হতে পারত না।
এইভাবে দীর্ঘদিন ধরে কড়া ডায়েটের ফলে ওই সন্ন্যাসী যখন একেবারেই মৃতপ্রায়, তখন তাকে মাটির নীচে একটি কক্ষে স্থানান্তর করা হত। তিনি সেই কক্ষের ভিতরেই ধ্যানে বসতেন। আর বাঁশের তৈরি একটি ফানেলের মধ্যে দিয়ে শ্বাস নিতেন।
এই ভাবেই তিনি মাটির নীচে ওই কক্ষে পড়ে থাকতেন। তিন বছর পর অন্য সন্ন্যাসীরা তাকে কক্ষ থেকে বার করে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন। কোনও সন্ন্যাসীর যদি মমিফিকেশন না হয়ে থাকে, তা হলে তাকে কবর দেওয়া হত।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে মমিফাইড সন্ন্যাসীরা মৃত নন। তারা অমরত্ব লাভ করেছেন এবং এভাবেই ধ্যানে মগ্ন। তবে যারা নিজেদের মমি করার চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে খুব কমই সফল হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরকম বৌদ্ধ মমি এবারই প্রথম না।
গত ৫০বছরে প্রায় 40টির মত তিব্বতীয় মমিফাইড সন্যাসী পাওয়া গেছে। এই যেমন মঙ্গোলিয়ায় পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা প্রায় দুশো বছরের পুরনো এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মমি উদ্ধার করা হয়েছে। মমিটার সারা দেহ পশুর চামড়া দিয়ে আবৃত ছিল।
তবে বৌদ্ধ মূর্তির মধ্যে প্রাপ্ত প্রথম সন্ন্যাসীর মমি এটা।
হাঙ্গেরির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে বহুদিন ধরেই ওই মূর্তি প্রদর্শিত হয়েছে। তারপর ইউরোপের লুক্সেমবার্গ মিউজিয়ামেও কিছুদিন রাখা ছিল মূর্তিটি। তারপর থেকে নেদারল্যান্ডের ড্রেন্টস মিউজিয়ামে তার ঠিকানা এখন।
https://edition.cnn.com/2015/02/27/asia/mummified-monk-statue/index.html
https://www.bd-pratidin.com/mixter/2020/02/17/502782
যাইহোক,
সারকথা হলো-
১.
বৌদ্ধ মূর্তিকে সিটিস্ক্যান করে তার ভেতর এক মমি হওয়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পাওয়া গেছে।
২.
বৌদ্ধ মমিটার দেহের ভেতর কোনো অঙ্গই পাওয়া যায়নি বরং তার পরিবর্তে পাওয়া গেছে চায়না শব্দে লেখা কিছু লিখিত কাগজ।
৩.
যেহেতু মমিটার দেহের ভেতর অঙ্গের পরিবর্তে লিখিত কাগজ পাওয়া গেছে তার মানে অবশ্যই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীটার মৃত্যুর পর তাকে মমিফাইড করা হয়েছে বা যদি নিজে নিজেই মমিফাইড প্রক্রিয়া করে থাকে তবে সে কাগজগুলো বাইরের কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে ঢুকিয়েছে।
৪.
আর যেহেতু এত জায়গা বাদ দিয়ে মূর্তির ভেতরে পাওয়া গেছে তারমানে মমিটার সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে কারো না কারো হাত আছে যে এ পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
৫.
শিরোনামটা এভাবে দিলে কনফিউশন সৃষ্টি হত না-
"ধাতব বৌদ্ধ মূর্তির মধ্যে ধ্যানমগ্নের মতো দেখতে এক মমিফাইড সন্ন্যাসী পাওয়া গেল"।
আজকাল চোখ, কান খোলা রেখে সবকিছু বিচার বিবেচনা করা উচিত
কারণ গুজবে চারপাশ ভরপুর।
রেফারেন্স:
https://www.thesun.co.uk/news/9125459/1000-year-old-buddhist-statue-skeleton-monk-inside/
https://www.history.com/news/ct-scan-reveals-mummified-monk-inside-ancient-buddha-statue
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন