ভুল সংলাপ

জাবেদ ইকবাল





গত কিছুদিন থেকে পোস্ট দেখছি ফেইসবুকে রজার পেনরোজ বলেছেন, 


"এই ইউনিভার্স একমাত্র না; তার আগেও আরো ইউনিভার্স ছিল, বিগ ব্যাং এই ইউনিভার্সের শুরু না।"


পেনরোজ কী আসলেই এই কথাগুলি বলেছেন? কথা না বাড়াতে চাইলে ছোট্ট উত্তর, হ্যাঁ বলেছেন। কিন্তু এই উত্তর ১০০% সঠিক না; বিজ্ঞানীদের জন্য উত্তরটা একটু লম্বা হবে।



০। পেনরোজ একজন গণিতবিদ ও রিলিটিভিটি বিশেষজ্ঞ। ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণা করেছেন স্টিফেন হকিং এর সাথে, এবং ২০২০এ ফিজিক্সে নোবেল পেয়েছেন। সুতরাং তার কোন কথাই ফেলে দেয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান অন্ধভাবে বিশ্বাসও করে না।


১। পেনরোজ এটাকে বলেছেন সাইক্লিক ইউনিভার্স--বর্তমান ইউনিভার্সের আগে আরেকটা ইউনিভার্স ছিল, তার পরে আরেকটা হবে, ইত্যাদি। সাইক্লিক ইউনিভার্স নিয়ে এটা পেনরোজের প্রথম বক্তব্য না। তিনি ৩২ বছর আগে এই কথা বলেছেন। 


২। সাইক্লিক ইউনিভার্স পেনরোজ প্রথম প্রস্তাব করেন নাই। আইনস্টাইন ১৯২৬ সালে এটা নিয়ে কথা বলেছেন


৩। জামাল নজরুল ইসলাম The Ultimate Fate of the Universe এ এটা নিয়ে কয়েক যূগ আগে লিখে গিয়েছেন,

 “One way in which a recurrence of life can occur is in the event that the cycle of the big bang and final collapse is repeated, and if galaxies are born again and again conditions for the existence of life may develop in some regions. Whether or not this can happen (assuming that the universe is closed) is, of course, not known.”


৪। পেনরোজ যেটা বলেছেন, সেটা হচ্ছে, মহাজাগতিক বিকিরণে (Cosmic Microwave Background, CMB) আমাদের চাঁদের প্রায় আট গুন ব্যাসের অনেকগুলি অপেক্ষাকৃত উষ্ম স্থান দেখা যায়। তার মধ্যে ছয়টার তাপমাত্রা CMB- র গড় তাপমাত্রার প্রায় ৩০ গুণ। পেনরোজ এটা নিয়ে প্রথম পেপার পাবলিশ করেছেন ২০১০ সালে। (২য় লিংক)।


স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ব্ল্যাক হোল থেকেও বিকিরণ হয়, যেটার নাম দেয়া হয়েছে হকিং রেডিয়েশন। (ব্ল্যাক হোল থেকে আলো বের হতে পারে না, তাহলে কীভাবে বিকিরণ বের হয়, সেটা নিয়ে বিসিবিতে আলাদা লেখা আছে, ৪র্থ লিংকের কমেন্টে)। এটার এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। পেনরোজ বলেছেন, এই ছয়টা অপেক্ষাকৃত গরম জায়গা আসলে হকিং রেডিয়েশন। হকিং রেডিয়েশনের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের ক্ষয় হয়, এবং হকিং রেডিয়েশনের জন্য সেই স্থান একটু গরম থাকে। যেহেতু একটা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল সম্পূর্ন ক্ষয় হতে আমাদের ইউনিভার্সের মোট বয়সের চাইতে বেশি সময় লাগে, তাই পেনরোজের ধারণা, এগুলি আগের ইউনিভার্সের ব্ল্যাক হোল।


৫। হঠাত করে পোর্টালগুলি এটাকে ভাইরাল বানাচ্ছে কেন বুঝলাম না। পেনরোজ নোবেল পেয়েছেন অক্টোবরে; তখন এটা নিয়ে আবার কথা বলেছেন, এখন ডিসেম্বরে এসে মনে হচ্ছে সাংবাদিকদের ঘুম ভেঙ্গেছে।


৬। পেনরোজ কী বলেছেন, বিগ ব্যাং আমাদের মহাবিশ্বের শুরু না? ঝামেলাটা এখানেই—বিজ্ঞানীদের কথা যখন সাধারণ সাংবাদিকরা লিখতে যায়, এই ধরণের ঘোট পাকিয়ে ফেলে। পেনরোজের ২০১০ এর পেপার (৩য় লিংক) এ বলা হয়েছে, বিগ ব্যাং এর আগে কিছু ছিল না, এটা বলা ভুল—পেনরোজের কথা অনুযায়ী, তার আগে আরো ইউনিভার্স ছিল যেগুলি একের পর এক বিগ ব্যাং এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এবং আমরাও দূর ভবিষ্যতে আরেকটা বিগ ব্যাং এর দিকে ধাবিত হচ্ছি। দুইটা বিগ ব্যাং এর মধ্যের সময়কালকে পেনরোজ ও তার সহগবেষকরা নাম দিয়েছেন ইয়ন (aeons)।


৭। পেনরোজ বলেছেন বলেই কি কথাটা সত্যি? না। এমনকি পেনরোজের মত মানুষকেও তার যুক্তি প্রমাণ সহ তুলে ধরতে হয়, যেই কাজ তিনি ১০ বছর আগে পেপার পাবলিশ করার মাধ্যমে করেছেন। সেটা অন্য বিজ্ঞানীরা নিজেরা আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখবেন/দেখছেন। তার এই তত্ব বর্তমানে বিতর্কিত; সুতরাং এটা নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। সময়ে উত্তর পাওয়া যাবে, সেটা আমাদের জীবনকালে নাও হতে পারে।


সোর্স:

১.

https://www.maths.ox.ac.uk/node/36137

২.

https://physicsworld.com/a/penrose-claims-to-have-glimpsed-universe-before-big-bang/

৩.

https://arxiv.org/ftp/arxiv/papers/1011/1011.3706.pdf

৪.

https://www.facebook.com/groups/bcb.science/permalink/3086988414718140


জাবেদ ইকবাল,

ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

২টি মন্তব্য: