মিথ: মশার কামড়ে এইচ.আই.ভি (H.I.V.) বা এইডস (A.I.D.S.) ছড়ায়!

স্বপ্নীল জয়ধর


(এই গুজবটা জানি না কতটুকু গুজব হলো। কিন্তু তারপরও লেখছি কেননা এই বিষয়টা নিয়ে আমার কেন আমার আশে পাশের কয়েকজন বন্ধুরও একই ধারণা ছিল।)

যাই হোক শুরু করা যাক। এই গুজব সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা অবশ্য ৯ম-১০ম শ্রেনীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' বইয়ের শেষের অধ্যায় থেকে আমাদের জন্মায়।

সেখানে একজায়গায় লেখা আছে,

"এইচ.আই.ভি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ (ইঞ্জেকশন), ব্লেড বা অন্যান্য জিনিস একজন সুস্থ মানুষ ব্যবহার করলে তার এইচ.আই.ভি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বা এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।"

আবার আরেক জায়গায় লেখা আছে, 

"এইচ.আই.ভি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যদি কোনোভাবে একজন সুস্থ মানুষের রক্তের সংস্পর্শে আসে তবে তার এইচ.আই.ভি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বা এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।"

(অন্তত এররকমই কিছু লেখা আলসেমির কারণে বই খুলতে ইচ্ছা করছে না।)

সে কথা বাদ দেই। এই লাইনটা পড়ে অনেককের মাথায় হয়ত প্রশ্ন জেগেছে। ভাবুন ভাবুন। 

প্রশ্ন না জাগলেও সমস্যা নাই সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্নটা পড়তে পারেন।


প্রশ্নটা অনেকটা এই রকম, কোনো রক্তখেকো কীট যেমনঃ মশা তো অনেক রক্তবাহিত রোগ ছড়ায়। যদি এই মশা একজন এইচ.আই.ভি ভাইরাসে বা এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত খেয়ে নেওয়ার পর অন্য একজন একজন সুস্থ মানুষের রক্ত খায় তবে কি তার এইচ.আই.ভি ভাইরাসে বা এইডসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? 

(জানি প্রশ্নটা অতটা ক্লিয়ার না। তবে অন্তত চলনসই)

এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে না। মশার কামড়ে এইচ.আই.ভি বা এইডস ছড়ায় না।

খুব জানতে ইচ্ছা করছে না কেন ছড়ায় না। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক কেননা এই হতভাগা মশা এত রোগ ছড়াতে পারার পরও এইচ.আই.ভি ভাইরাস ছড়াতে পারে না।


১) মশার সুচ আর সিরিঞ্জের সুচ নয়ঃ

অনেকে মনে করে মশার সুচ আর সিরিঞ্জের সুচ এক। কিন্তু আসলে তা নয়। মশার সুচ আর সিরিঞ্জের সুচ এক নয়। উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এ নিয়ে পরে নিচে আলোচনা করব।  

আপতত যদি আপনার মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে আমি বলব আপনি হাতে একটা মশা নেন আর একটা সিরিঞ্জ নেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন আসল কাহিনী। যদি বুঝে থাকেন তাহলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাক।

যখন একজন এইচ.আই.ভি আক্রান্ত ব্যাক্তি সিরিঞ্জের সুচ ব্যবহার করে তখন সেই সুচে বেশ কিছু পরিমাণ রক্ত লেগে থাকে। যা পরে একজন সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করলে সেই রক্ত তার রক্তের সংস্পর্শে আসে ফলে সে এইডসে আক্রান্ত হয়। 

আর অন্যদিকে একটি মশা যখন একজন মানুষের কাছ থেকে রক্ত খায়, তখন সে খুবই অল্প পরিমাণ রক্ত তার সুচে লেগে থাকে আর এরপর যখন সেই মশা একজন সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তখন সেই রক্ত তার রক্তের সংস্পর্শে আসে ঠিকই বাট তা তাকে এইচ.আই.ভি. তে আক্রান্ত করার মতো যথেষ্ট নয়। ফলে মশার সিরিঞ্জের মাধ্যমে এইচ.আই.ভি. ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।  

(এতটুকু পড়ে যদি ধারণা করে নেন যে মুলত এই কারণেই মশা এইচ.আই.ভি. ভাইরাস বা এইডস ছড়ায় না তাহলে বলব এখনো আরো কয়েকটা কারণ আছে যার কারণে মশা এইচ.আই.ভি. ভাইরাস বা এইডস ছড়ায় না।)


২) মশার পেট এইচ.আই.ভি. ভাইরাসের সংরক্ষণাগার নয়ঃ

আবার যদি ধরে নেওয়া হয় মশায় পর্যাপ্ত রক্ত খাইছে আর তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাইরাস রয়েছে। তবুও মশা এইচ.আই.ভি. ভাইরাস ছড়াতে পারে না। কেননা মানব দেহের বাইরে এইচ.আই.ভি. কে বাঁচতে হলে অন্তত- ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং বিশেষ কেমিক্যালসহ উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। কিন্তু মশার পেটের মধ্যে সেই রকম কোনো ব্যবস্থাই থাকে না। তাই মশা এইচ.আই.ভি. ভাইরাস ছড়াতে পারে না। আবার এইচ.আই.ভি. ভাইরাস CD4+ সেল ছাড়া বাঁচতে পারে না। আর CD4+ সেল একমাত্র মানুষ আর ইঁদুরের দেহেই থাকে। আর মশার এইচ.আই.ভি. ভাইরাস ছড়ানোর পিছনে এটাও একটা কারণ। 

আবার ধরেও নিলাম মশার মধ্যে CD4+ সেল রয়েছে। মশা কিন্তু তারপরও এইচ.আই.ভি. ভাইরাস ছড়াতে পারবে না। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মশার পেটে থাকা এসিড। এই এসিড এইচ.আই.ভি. ভাইরাসকে পেটেই ধ্বংস করে দেয় তাই কোনো বংশবৃদ্ধি করতে পারে না, তাই মশার দিয়ে এইচ.আই.ভি. ছড়াতে পারে না।

এখন আপনার মনে হয়ত প্রশ্ন জাগতে পারে যদি এইটা সত্যি হয় তাহলে মশা ম্যালেরিয়ার, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাসগুলো কিভাবে মশা ছড়াতে পারে???

ওয়েল এই প্রশ্নটা আসাটা স্বাভাবিক। আসলে অন্যান্য ভাইরাসগুলো এইচ.আই.ভি. ভাইরাসের মতো অতটা এসিডের প্রতি সংবেদী নয়। তাই এই ভাইরাসগুলো এসিড দ্বারা পেটে ধ্বংস হয় না। ফলে এইসব ভাইরাস অবাদে বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং মানুষকে অসুস্থ করে দিতে পারে।


আবার যদি মশা উপরের শর্তগুলো বিনা বাধা পালন করে ভাইরাস ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত হয়েও যায় তারপরও একজন মানুষকে এইচ.আই.ভি পজিটিভ করতে অন্তত 10,000,000 মশার কামড় লাগবে। তারপরও তার এইচ.আই.ভি পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবণা অন্তযন্ত ক্ষীণ থাকে।


সুতরাং বলাই যায় মশার কামড়ে এইচ.আই.ভি (H.I.V.) বা এইডস (A.I.D.S.) ছড়ায় না। মিথ পুরাই মিথ্যা।


তথ্যসূত্রঃ

1) https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mosquito-borne_disease

2) https://en.m.wikipedia.org/wiki/CD4

3) https://www.nature.com/scitable/blog/viruses101/why_cant_mosquitos_transmit_hiv/

4) https://bigganjatra.org/virology-rumor-02/


স্বপ্নীল জয়ধর

ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন